ইসির ভেতরেই সংকট থাকলে ভোটাররা কোথায় যাবেন?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ।।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ এখন একদম কাছে। দশদিনের মতো সময় হাতে আছে। এ নির্বাচনে প্রায় সব প্রধান দলের অংশগ্রহণ, বিভিন্ন দলের তৎপরতার বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে। এর মধ্যেই নির্বাচন পরিচালনা প্রতিষ্ঠান-ইসির বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত ও দৃষ্টিকটূ ভূমিকা সামনে চলে আসছে। যা দেশের সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে হতাশ করছে এবং আশাহত করছে বলে নাগরিকরা অভিমত ব্যক্ত করছেন।

যদিও এ কথাই সত্য যে, প্রচলিত পদ্ধতির এসব নির্বাচন এবং এ জাতীয় পদ্ধতির ফলে প্রকৃত কোনো কল্যাণ বয়ে আসার সম্ভাবনাটা দেখতে পাওয়ার সুযোগ থাকে না। আল্লাহমুখী জীবন, রাজনীতি ও প্রশাসনের প্রচলনের আগে এ জাতীয় পদ্ধতির মধ্য থেকে ভালো ও কল্যাণকর কিছু প্রত্যাশা করার সুযোগও থাকে না। তবুও দেশের নাগরিক হিসেবে এ ধরণের চলমান পরিস্থিতির মধ্যেও যেন দেশ ও জনগণ বড় কোনো ক্ষতির সম্মুখীন না হয়ে যায় – সেজন্য আমরা কিছু মতামত পেশ করার চেষ্টা করি। অনেক সময় দরকারও মনে করি।

সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন বা ইসির দুই কমিশনারের মধ্যে যে প্রকাশ্য বিবাদের সূচনা হয়েছে তাতে ভোটার জনসাধারণের মধ্যে এক ধরনের অনির্ভরতা সৃষ্টি হচ্ছে, বলা যায়। ভোটের প্রচার–প্রচারণার ক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যেসব অনভিপ্রেত ঘটনার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে চলে এসেছে, তাতে ইসির একজন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন- ‘নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই।’

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড – কথাটার সরল অর্থ হলো, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের  জন্য খেলার মাঠ সমতল হওয়া। একদিকে উঁচু, আরেকদিকে নিচু এমন না হওয়া।  নির্বাচনের ময়দানে একদল সুবিধা পাবে, আরেকদল আক্রান্ত হবে – এমন না হওয়া । মাহবুব তালুকদার তার বক্তব্যে সে কথাই বলেছেন যে, ভোটের মাঠ সব দলের জন্য সমতল নয়। কিন্তু একদিনের ব্যবধানেই রাঙ্গামাটির একটি অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের ওই বক্তব্যকে ‘অসত্য’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, ভোটের ময়দান সমতল।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা সিইসির এ জাতীয় বক্তব্যে প্রধানত নির্বাচন কমিশনের ভেতরের একটি বিবাদের  বিষয় প্রকাশ্যে চলে এল। তিনি প্রকাশ্যে তার এক সহকর্মীর বক্তব্যকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করে বুঝিয়ে দিলেন, নির্বাচন পরিচালনার বিষয়ে তারা একমতে এবং একপথ নন। তাদের ভেতরে পরষ্পর অনাস্থা ও ঝগড়া আছে। বড় দায়িত্বশীল হিসেবে এভাবে ভিন্নমত থাকলেও প্রকাশ্যে কথা না বললেও তিনি পারতেন। ঘরের ঝগড়া ঘরের মধ্যে মিটিয়ে নিতে পারতেন।

দ্বিতীয় কথা হলো, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কি এমন কোনো বিষয় যে সেটা বোঝার জন্য প্রযুক্তির আশ্রয় নিতে হয়? এটা কি অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে হয়? কিংবা এ বিষয়টি বোঝার জন্যে কি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কোনো জ্ঞান দরকার? এ বিষয়টি বোঝার জন্য শিক্ষিত হওয়ারও কোনো দরকার মনে হয় না। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণির মানুষই দেখতে পাচ্ছে, একটি দল নির্বাচনী সব কাজ নির্বিঘ্নে করতে পারছে, পুলিশ তাদের সহযোগিতা করছে। বিপরীত দিকে অপর একটি দল ও গোষ্ঠীর লোকদের নির্বাচনী কোনো কাজই  ঠিকমতো  করতে দেওয়া হচ্ছে না। মারধর, হামলা, পায়ে গুলি, মামলা, গ্রেফতার চলছে। এতে নির্বাচনের ময়দানটা যে সমতল থাকছে না – এটা বুঝতে কারো কোনো কষ্ট হচ্ছে না। গণমাধ্যমেও তো এসব খবর ও আলোচনা প্রতিদিন আসছে।

সুতরাং এমন পরিস্থিতিতে ইসি কমিশনার মাহবুব তালুকদারের ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই’ কথাটিকে ‘অসত্য’ বলে সাব্যস্ত করে সিইসি যে বক্তব্য দিয়েছেন – তার তো কোনো সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা থাকার কথা নয়। আস্থা ও নির্ভরতা পাওয়ার মতো কোনো কথা নয় তার এই কথাটি। ভোটার জনসাধারণ সিইসির এই বক্তব্য ও অবস্থানের কারণে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগের শিকার হয়, তবে কি তাদের দায়ী করা যাবে?

অবশ্য সিইস‘সহ ইসির অন্য কমিশনারদের যদি নির্বাচন নিয়ে ভিন্ন রকম টার্গেট থেকে থাকে, তাহলে ভিন্ন ব্যাপার। তাদের কাছে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা ও নির্ভরতার আলোচনা করে ফায়দা বিশেষ নেই।

একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এখানে শপথের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু চাইলেই এখান থেকে দায়িত্বশীলদের বিয়োগ করা যায় না। কোনো কারণে কাউকে বিয়োগ করতে চাইলে অনেক রকম বিড়ম্বনাকর প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। তাদের আস্থা, দায়িত্ব, ক্ষমতা অনেক। সারা বিশ্ব রাষ্ট্রের এ জাতীয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। বিশেষত নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়সহ গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে সকলের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকে নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এজন্য আস্থা রক্ষার দায়িত্বটা তাদের অনেক বড়।

একটি রাষ্ট্রের উন্নতি ও অগ্রগতির সবকিছু টাকা-পয়সা, অর্থকড়ির উন্নতি দিয়ে মাপা হয় না। ভবন-সেতু আর কলকারখানা দিয়েই চূড়ান্তভাবে সাব্যস্ত হয় না। বরং ওই রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো কতোটা সুষ্ঠুভাবে কাজ করছে, বা কাজ করতে পারছে সেটাও দেখা হয়। যদি এমনই একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান দায়িত্বশীলদের মধ্যে প্রকাশ্যে ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়ার খবর দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তবে তাতে কেবল তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হন এমন নয়, বরং এতে দেশ ও জাতির মর্যাদাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আঘাতপ্রাপ্ত হয়। বাইরের দেশগুলো থেকে  সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ভেতরে এ জাতীয় কলহ-বিবাদ ও অনাস্থার বিষয়গুলোকে অত্যন্ত খারাপ চোখে দেখা হয়।

একজন কমিশনার নির্বাচনের মাঠ বিষয়ে তার বিশ্লেষণ ও মতামত তুলে ধরেছিলেন। সাধারণ মানুষের মতামত ও গণমাধ্যমেও তার বিশ্লেষনের সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে। সেসময় ওই পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে প্রকাশ্যে সিইসি এত কঠোর ভাষায় নিন্দা বা অসত্য না বললেও পারতেন। এতে জাতি হতাশ হয়। সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পর্কে সন্দিহান হয়। তারা তাদের ঝগড়ার মাধ্যমে দেশের মানুষকে এভাবে অপমানিত ও হতাশ করতে পারেন না। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারে বসে তারা এমন করলে দেশের মানুষ কোথায় যাবে?

আরেকটি ব্যাপার চোখে পড়ছে সবার। ইসি সচিবের এত দৃষ্টিকটূ ও গায়েপড়া কথাবার্তা কেন বলতে হবে? তিনি তো কমিশনের শপথ গ্রহণকারী সাংবিধানিক ক্ষমতাসম্পন্ন কেউ নন। রাষ্ট্রের একজন কর্মচারী মাত্র। তাকে ওই প্রতিষ্ঠানের কাজে সহযোগিতার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দাপট ও হামবড়া ভাব নিয়ে একের পর এক বক্তব্য দিয়েই যাচ্ছেন তিনি। একজন প্রার্থী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘সে আমাদের হাইকোর্ট দেখাচ্ছে’। এভাবে কি তিনি কথা বলতে পারেন? যার সম্পর্কে এ কথা বলা হয়েছে – যদি প্রার্থী হওয়ার জন্য ইসি শিক্ষা-দীক্ষা ও অন্যান্য যোগ্যতার কোনো মাপকাঠি ঠিক করে রাখে এবং সে হিসেবে তাকে বাদ দেয়, তো ঠিক আছে। এমন আইন পারলে তারা করুক। কিন্তু তা না করে একজন প্রার্থী সম্পর্কে এভাবে কথা বলার অধিকার ইসি সচিব কোথায় পেলেন?

দ্বিতীয় কথা হল, ওই প্রার্থী সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে – অভিযোগ ওঠেছে – তিনি প্রকারান্তরে আদালত অবমাননা করেছেন। জানা গেছে, ওই প্রার্থীর মনোনয়ন প্রথম পর্যায়ে গৃহীত না হওয়ায় হাইকোর্টের রায় নিয়ে তিনি নির্বাচনে বৈধ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এখন লড়ছেন। এই যে হাইকোর্টের রায় নিয়ে তিনি এলেন, এটাকেই ব্যঙ্গ করে ইসি সচিব বলেছেন, ‘সে আমাদের হাইকোর্ট দেখাচ্ছে।’ হাইকোর্টের রায়কে ‘হাইকোর্ট দেখানো’ বলে মত দেওয়া সাদা চোখে আদালত অবমাননারই শামিল।

ইসি সচিবের এই আদালত অবমাননামূলক বক্তব্যের বিষয়ে এখানে আদালত কোনো পদক্ষেপ না নিলেও এ কথা বলা যায় যে, যেসব দেশে আদালত এ জাতীয় ক্ষেত্রে প্রখর দৃষ্টি রাখেন-তারা এতক্ষণে সুয়োমুটো মামলা জারি করতেন এবং কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে যেত – এমন নজির দেশে দেশেই আছে।

দেখুন, ‘হাইকোর্ট দেখানো’ একটি বাংলা প্রবাদের ভাষা। এটা তখন রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। কেউ অনেক বড় কোনো দাবি বা চ্যালেঞ্জ দিলে এ জাতীয় ভাষা ব্যবহার করা হয়। তখন এটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু ইসি সচিব যে অর্থে এ বাক্য ব্যবহার করেছেন, সেটা তেমন নয়। বরং এখানে প্রকৃত অর্থেই হাইকোর্ট জড়িত। হাইকোর্টের প্রকৃত রায়কে অবজ্ঞা করেই তিনি বলেছেন-‘হাইকোর্ট দেখাচ্ছে’। এটা প্রকাশ্যে আদালত অবমাননাকর বক্তব্যের মধ্যে পড়ে যায়।

মোটকথা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও একজন কমিশনারের মধ্যে প্রকাশ্যে বিরোধ এবং ইসি সচিবের অনভিপ্রেত ও আপত্তিকর কথাবার্তায় নির্বাচন কমিশন ও আসন্ন নির্বাচন নিয়েই এক ধরনের সংশয় ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। নির্বাচন কমিশনের ভেতরেই যদি এমন সব অব্যবস্থাপনা, অনির্ভরতা ও অনাস্থার পরিস্থিতি তৈরি হয় তবে সাধারণ মানুষ ও ভোটাররা কোথায় যাবে? কার প্রতি আস্থা রাখবে?

এ জাতীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় অনেক রকম ত্রুটি থাকবেই – এটা বোঝা যায়। প্রকৃত আল্লাহভীরু সমাজ ব্যবস্থাপনা ও তাকওয়ার পথে যেতে না পারলে রাষ্ট্রের নীতি ও দায়িত্ব নির্ধারণের বিষয়গুলো সঠিকভাবে ফয়সালা হওয়া দুরূহ। আমাদেরকে সেই দিকেই ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

পূর্ববর্তি সংবাদতালেবান-মার্কিন শান্তি আলোচনা সফলতার দিকে
পরবর্তি সংবাদনির্বাচনের কারণে রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তা জোরদার