ইসলামি দলগুলোর প্রার্থীদের সম্ভাবনা কতটুকু?

জহির উদ্দিন বাবর ।। 

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। নির্বাচনী উত্তাপ বইছে সারাদেশে। ১০ বছর পর একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এই নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের বাড়তি উচ্ছ্বাস থাকার কথা। তবে সাধারণত আমাদের দেশের নির্বাচনগুলো যে উৎসবমুখর হয় সেটা এবার হচ্ছে না। কারণ ভোট সুষ্ঠু হবে কি না কিংবা আদৌ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কি না এটা নিয়ে এখনও জনগণের যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। ভোটের মাঠে ক্ষমতাসীনদের দাপিয়ে বেড়াতে দেখা গেলেও বিরোধী দলগুলো নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কোনোরকম টিকে আছে। এই অবস্থায় ভোটের হিসাব-নিকাশ নিয়ে ভোটাররা যতটা মাতোয়ারা হওয়ার কথা সেটা হচ্ছে না। তবুও দেশবাসী আশায় বুক বাঁধছে, শেষ পর্যন্ত মোটামুটি সুষ্ঠু একটি ভোট হবে এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিতরা ক্ষমতায় বসবে।

বরাবরের মতোই ইসলামি দল এবং প্রার্থীদের নিয়ে সবার বাড়তি একটা কৌতূহল রয়েছে। ইসলামি দলের কে কোথায় নির্বাচন করছেন, তাদের অবস্থা কী রকম – এটা জানতে চান তারা। প্রতিবারের মতো এবারের নির্বাচনেও ইসলামি দলগুলোর মোটামুটি চোখে পড়ার মতো অংশগ্রহণ রয়েছে। বেশির ভাগ ইসলামি দল ভোটের লড়াইয়ে রয়েছে। কেউ জোটের সঙ্গে আবার কেউ নিজ দলের হয়ে লড়াই করছেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকে দুটি ইসলামি দলের অন্তত ছয়জন প্রার্থী নির্বাচন করছেন। এর বাইরে নিজ পরিচয়ে ভোটের লড়াইয়ে আছেন আরও বেশ কয়েকজন প্রার্থী; যারা আলোচনায় রয়েছেন। তাদের মধ্যে কারও কারও সম্ভাবনা উজ্জ্বল। শেষ পর্যন্ত তাদের কতজন সেই সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে সংসদে যেতে পারবেন তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর আগে দেখে আসা যেতে পারে তাদের অবস্থান ও সম্ভাবনা।

২০ দলের শরিক দুটি ইসলামি দলের ছয়জন প্রার্থী ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। এর মধ্যে দুজন সাবেক সংসদ সদস্য। দুজন আগে নির্বাচন করলেও জয় পাননি। আর দুজন প্রথমবারের মতো ভোট করছেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের দুই অংশের চারজন প্রার্থী এবার ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করছেন। এর মধ্যে মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস সাবেক এমপি ও মন্ত্রী। তিনি এবারও নির্বাচন করছেন যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসন থেকে। এই আসন থেকে তিনি আগেও বিজয়ী হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন কয়েকবার। এরশাদ সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। এবার ধানের শীষ নিয়ে এলাকায় গেলেও স্থানীয় বিএনপি তাকে মেনে নিতে পারেনি। তিনি মনোনয়ন পাওয়ায় কয়েক হাজার নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন। ভোটের মাঠেও বিএনপির একটি বড় অংশ তার সঙ্গে এখনও যুক্ত হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিএনপি তাকে সহযোগিতা না করলে ভোটের লড়াইয়ে উত্তীর্ণ হওয়া অভিজ্ঞ এই রাজনীতিকের জন্য কঠিন হবে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে। হামলার ঘটনাও ঘটেছে। নানা প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে ভোটের ফলাফল নিজের পক্ষে আনা অনেকটা কঠিন হবে তার জন্য। তবে তিনি এবং তার নেতাকর্মী ও অনুসারীরা আশা ছাড়ছেন না।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের আরেক প্রার্থী মাওলানা শাহীনূর পাশা চৌধুরী। তিনি নির্বাচন করছেন সুনামগঞ্জ-৩ (জগন্নাথপুর-দক্ষিণ সুনামগঞ্জ) আসন থেকে। তিনিও সাবেক সাংসদ। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে হেরে যান। পরে তার মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে মাওলানা পাশা অষ্টম সংসদে কিছু দিনের জন্য সাংসদ হয়েছিলেন। এবার তার বিপরীতে নির্বাচন করছেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান। প্রার্থী হিসেবে তিনি বেশ বলিষ্ঠ। আগামীতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তার অর্থমন্ত্রী হওয়ার কথা আলোচনায় আছে। তাকে বিজয়ী করে আনতে আওয়ামী লীগের চেষ্টার কোনো কমতি থাকবে না। তার সঙ্গে লড়াই করে মাওলানা পাশার জন্য বিজয় ছিনিয়ে আনা খুব সহজ হবে না। এছাড়া তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, মামলা-হামলায় নেতাকর্মীদের হয়রানিসহ নানা প্রতিকূলতা তো আছেই। তবুও জয়ের ব্যাপারে তিনি নিজে এবং তার দল অনেকটা আশাবাদী।

সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনে এবার ধানের শীষের মনোনয়ন পেয়েছেন জমিয়ত নেতা মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুক।  তিনি এর আগেও এই আসনে নির্বাচন করেছেন, তবে ধানের শীষ নিয়ে এবারই প্রথম। তার নিজস্ব একটি ভোটব্যাংক আছে। যদিও আসনটিতে জামায়াতে ইসলামী বেশ শক্তিশালী। এছাড়া ফুলতলী পীর সাহেবের অনুসারীদেরও একটা ভূমিকা আছে। জামায়াতের সঙ্গে জমিয়তের একটা দূরত্ব বরাবরই আছে। সে হিসেবে জামায়াতের ভোট শেষ পর্যন্ত মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুকের বাক্সে যাবে কি না সেটা নিয়ে কিছুটা সন্দেহ আছে। ফুলতলীপন্থীরা ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়ায় তাদের ভোট পাওয়ার আশাও কম। যদিও ধানের শীষের প্রার্থী ফুলতলী পীর সাহেবের কবর জিয়ারত করে তার অনুসারীদের সমর্থন চেয়েছেন। সর্বোপরি এখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যিনি প্রার্থী হাফিজ মজুমদার, এলাকায় তার একটি ক্লিন ইমেজ আছে। শিক্ষাবিদ হিসেবে পরিচিত। তাকে হারানো মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুকের জন্য অনেক কঠিন হবে।

জমিয়তের আরেক প্রার্থী মুফতি মুনির হোসেন কাসেমি মনোনয়ন পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসন থেকে। তার মনোনয়ন পাওয়াটা বেশ চমক সৃষ্টি করেছে। এলাকায় তিনি তেমন পরিচিত নন। সাংগঠনিকভাবে জমিয়ত এখানে তেমন শক্তিশালীও নয়। আর তার বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম ওসমান, নানা কারণে যিনি সারাদেশে ব্যাপক আলোচিত। ওসমান পরিবারের আধিপত্যের সামনে যেখানে বিএনপিসহ কোনো রাজনৈতিক দলই টিকতে পারেনি সেখানে নবাগত মাওলানা মুনির কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারবেন সেটা বলা মুশকিল। সেই প্রশ্নের জবাব জানতে অপেক্ষা করতে হবে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

খেলাফত মজলিসের দুজন প্রার্থী এবার ধানের শীষের মনোনয়ন পেয়েছেন। দুটি আসনই হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট-মাধবপুর) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন দলটির মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের। আর হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন দলটির নায়েবে আমির মাওলানা আবদুল বাসিত আজাদ। আহমদ আবদুল কাদের আগেও ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করেছেন। আসনটি বরাবরই আওয়ামী লীগের দখলে থাকে। চা বাগান অধ্যুষিত আসনটির ভোটারদের একটি বড় অংশ চা-শ্রমিক। তারা কোনো প্রার্থী দেখে না, নৌকা দেখেই ব্যালটে সিল মারে। ২০০১ সালের সেই জোয়ারের সময়ও এই আসনে আহমদ আবদুল কাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়ে তুলতে পারেননি। তবে সময় পাল্টায়। এবার তিনি কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেন সেটা দেখতেও অপেক্ষা করতে হবে।

মাওলানা আবদুল বাসিত আজাদ প্রার্থী হিসেবে একদম নতুন। তার মনোনয়ন পাওয়াও এবারের একটি বড় চমক। এই আসনটিও বরাবরই আওয়ামী লীগের দখলে থাকে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থী কোনোবারই এখান থেকে বিজয়ী হতে পারেননি। মাওলানা আজাদ এলাকায় ‘বড়  হুজুর’ হিসেবে পরিচিত। ওই এলাকায় তার একটি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তবে ভোটের মাঠে তিনি কতটা দক্ষতার সঙ্গে লড়তে পারেন সেটা এখনই বলা যাবে না। সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবনকে বাদ দিয়ে জোটের স্বার্থে তাকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। স্থানীয় বিএনপি এই সিদ্ধান্ত এখনও পুরোপুরি মেনে নিতে পারেনি। এখানে তার বিপরীতে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির শক্তিশালী দুজন প্রার্থী রয়েছেন। জাপা প্রার্থী শংকর পাল সংখ্যালঘু ভোট টানতে মরিয়া চেষ্টা করছেন। এই আসনে ত্রিমুখী লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

জোটের বাইরে এবারের নির্বাচনে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বেশ সাড়া ফেলেছে। দলটি ৩০০ আসনেই তাদের নিজেদের প্রার্থী দিয়েছে। একটি আসনে প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যাওয়ায় ২৯৯ আসনে তারা হাতপাখা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এবারের নির্বাচনে এককভাবে তারাই সবচেয়ে বেশি প্রার্থী দিয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগ-বিএনপি থেকেও এক্ষেত্রে তারা এগিয়ে। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আলোচিত হচ্ছেন এমন প্রার্থীর সংখ্যা হাতেগোনা। এর মধ্যে দলটির সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা সৈয়দ ফয়জুল করিম বরিশাল-৫ (সদর) আসনে বেশ আলোচনায় রয়েছেন। এখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলেরই শক্তিশালী প্রার্থী রয়েছেন। তাদের সঙ্গে মাওলানা ফয়জুল করিমও ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়বেন এমনটাই মনে করা হচ্ছে। তিনি ঝালকাঠির একটি আসন থেকেও নির্বাচন করছেন। তবে বাকি আসনগুলোতে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীরা মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারেন – এমন কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না।

মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে গেছে বছর দুয়েক আগেই। এবারের নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগ জোটে যাচ্ছে এমন গুঞ্জন জোরেশোরে বইছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তারা নৌকায় উঠেনি বা উঠতে পারেনি। দলটির বেশ কয়েকজন প্রার্থী নিজস্ব প্রতীক মিনার নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে কোথাও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাদের নাম শোনা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস কয়েক মাস আগে এরশাদের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করে। মহাজোটের অংশ হিসেবে তারা এবার কয়েকটি আসনে নির্বাচন করবে এমনটা শোনা যাচ্ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এরশাদের জাতীয় পার্টি তাদেরকে একটি আসনও দেয়নি। চরমভাবে হতাশ হওয়া দলটির কয়েকজন নেতা এবারের নির্বাচনে নিজস্ব প্রতীক রিকশা নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে আছেন। তাদের কারও অবস্থা সম্ভাবনাময় এমনটা শোনা যায়নি।

শেষ সময়ে এসে খেলাফত মজলিসের প্রার্থী মুনতাসির আলী বেশ আলোচিত হচ্ছেন। তিনি এবার সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর) আসন থেকে দেয়াল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন। এই আসনে ধানের শীষের মনোনয়ন চেয়েও তিনি বঞ্চিত হন। এখানে ধানের শীষ পেয়েছিলেন গুম হওয়া বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা। তবে আদালতের রায়ে তার প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যাওয়ায় জোট বিকল্প প্রার্র্থীকেই বাছাই করতে হবে। যদিও শেষ পর্যন্ত মুনতাসির আলী জোট বা ইলিয়াস আলী পরিবারের সমর্থন পাবেন কি না এটা নিয়ে আছে সন্দেহ। কারণ নির্বাচনী মাঠে তিনি ইলিয়াস আলী পরিবারে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় তার ব্যাপারে একটি নেতিবাচক মনোভাব আছে স্থানীয় বিএনপির। এছাড়া ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের একজন প্রার্থীও আছেন এই আসনে। তিনিও শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমর্থন পেয়ে যেতে পারেন।

পূর্ববর্তি সংবাদনির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপিকে মাঠে দেখা যাচ্ছে না : প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তি সংবাদনতুন মাদক এনপিএস নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্বেগ প্রকাশ