নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পরও মিলছে না মাহফিলের অনুমতি

আতাউর রহমান খসরু ।। 

শীতকাল বাংলাদেশের ওয়াজ-মাহফিল মৌসুম। এ দেশে শীতকালের শান্ত আবহাওয়ায় মাহফিলের ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে যুগ যুগ ধরে। শীতের প্রায় প্রতিটি রাতেই বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে মাহফিলের আয়োজন থাকে। সাধারণ দ্বীনপ্রাণ মানুষ এসব মাহফিলে অংশগ্রহণ করে অর্জন করেন দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও চেতনা। মাহফিলের জন্য মুখিয়ে থাকে তারা। ঐতিহ্যবাহী মাহফিলগুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হতেও দেখা যায়।

কিন্তু এবারের চিত্রটা যেন একটু ভিন্ন। মাহফিলের উৎসবমুখর পরিবেশটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনের বিধি-নিষেধ আরোপ, পরে সীমিত অনুমতি দানের কারণে কোথাও মাহফিল হচ্ছেই না, আবার কোথাও মাহফিল হচ্ছে ছোট পরিসরে এবং ঘরোয়া আয়োজনে। নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে মাহফিলের পরিবেশে এক প্রকার ইতস্তত ভাব কাজ করছে আয়োজক ও বক্তাদের ভেতর।

আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপর নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচন শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত মাহফিল করা যাবে না মর্মে নির্দেশনা জারি হতে পারে বলে আভাস দেয়া হয়।

২০ নভেম্বর  জাতীয় নির্বাচন শেষ হওয়ার আগ (৩০ ডিসেম্বর) পর্যন্ত কোনো ধরনের ওয়াজ-মাহফিল বা ধর্মীয় সভা করা যাবে না মর্মে নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

ইসির নির্দেশনায় সারা দেশের দ্বীনদার মুসলমান, আলেম-উলামা ও সচেতন মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন অনেকেই। ২৬ নভেম্বর ইসির বিরুদ্ধে আইনী নোটিশও পাঠান ঢাকার একটি মাহফিলের আয়োজক কমিটি।

চতুর্মুখী প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখে ২৭ নভেম্বর ইসি সাধারণভাবে ওয়াজ-মাহফিল ও ধর্মীয় সভার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। কিন্তু রিটার্নিং কর্মকর্তার অনুমতির শর্ত বাকি রেখে দেন। এই শর্তের বেড়াজালেই আটকে যাচ্ছে দেশের অধিকাংশ ওয়াজ-মাহফিল।

ইসলাম টাইমসের পক্ষ থেকে দেশের কয়েকজন খ্যাতিমান বক্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানিয়েছেন, দেশের দুই তৃতীয়ংশ মাহফিলই এখন হচ্ছে না। কোথাও প্রশাসন অনুমতি দিচ্ছে না আবার কোথাও আয়োজকরা অনুমতি নেয়ার ঝামেলায় যাচ্ছে না। আবার কোথাও আনুষ্ঠানিক অনুমতি না দিয়ে বলা হচ্ছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে মাহফিল করে নিতে। তবে অনুমতি না পাওয়ার কারণেই অধিকাংশ মাহফিলগুলো হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তারা।

বৃহত্তর ময়মনসিংহের আলেমদের সংগঠন ইত্তেফাকুল উলামার নির্বাহী কমিটির সভাপতি মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ সাদী ইসলাম টাইমসকে বলেন, ‘দেশের অধিকাংশ মাহফিলই এখন হচ্ছে না। যেগুলো হচ্ছে না তার বেশির ভাগই প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়ার কারণে হচ্ছে না। অবশ্যই দুয়েক জায়গায় এমন হচ্ছে যে, আয়োজকরা ঝামেলা এড়ানোর জন্য অনুমতিই নিতে যাচ্ছেন না।’

তার নিজেরও অনেক মাহফিল বাতিল হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশিষ্ট এই আলেম।

সিরাজগঞ্জ রেলওয়ে মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা নজরুল ইসলামেরও একাধিক মাহফিল বাতিল হয়েছে বলে জানান তিনি।

মাহফিলের অনুমতি চাইতে গেলে কী বলা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুনেছি, কোনো কোনো কর্মকর্তা ভালো-মন্দ কোনো কথা শুনতেই চান না আবার কোনো কোনো কর্মকর্তা অনুরোধ করে বলেন, আমরা কয়েকদিনের জন্য দায়িত্বপালন করছি। নির্বাচনের পর কী হবে তা ঠিক জানি না। বক্তারাও বা কী বলবেন তাও তো জানি না। খালি খালি আমাদের ঝামেলায় ফেলবেন না।’

মাওলানা নজরুল ইসলাম পার্শ্ববর্তী জেলার একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি এমনও শুনেছি, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আয়োজকদের বলেছেন, প্রাতিষ্ঠানিক অনুমতি আমরা দিতে পারবো না। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও থানার ওসিকে যদি ম্যানেজ করে করতে পারেন তাহলে আমাদের আপত্তি নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক বক্তা বিষয়টির ভিন্ন একটি রূপ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘বিধি-নিষেধ আরোপের পর আমারও বেশ কিছু মাহফিল বাতিল হয়েছে এবং কিছু মাহফিল করাও গেছে। খোঁজ নিয়ে আমার মনে হয়েছে আয়োজকদের উপর নির্ভর করেই ওয়াজ-মাহফিলের অনুমতি দেয়া হচ্ছে।’

বিষয়টি বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, ‘যেখানে আয়োজকদের মধ্যে সরকার দলীয় লোক আছে এবং যারা প্রভাবশালী তাদের অনুমতি দেয়া হচ্ছে। আর যেখানে আয়োজকরা তুলনামূলক কম প্রভাবশালী তারা অনুমতি পাচ্ছে না। কারণ, রিটার্নিং কর্মকর্তারা ঝামেলায় পড়ার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না।’

যেহেতু দেশের অধিকাংশ মাহফিলই হয় স্থানীয় দ্বীনদার মানুষের উদ্যোগে –যাদের সঙ্গে ক্ষমতার চর্চা করা মানুষের সম্পর্ক কম থাকে- তাই অধিকাংশ মাহফিলই বাতিল হয়ে যাচ্ছে বলে মত দেন উল্লিখিত তিন বক্তা।

তারা মনে করেন, মাহফিলের উপর বিধি-নিষেধ নেই ঘোষণা দেয়ার পরও মাহফিলের অনুমতি প্রদানে খেয়ালি ও কৌশলী ভূমিকা নেয়া এক ধরনের প্রতারণা। যা সম্পূর্ণ অন্যায়।

তারা আরও বলেন, ‘অতীতেও নির্বাচনের সময় দেশে অনেক মাহফিল হয়েছে। তাতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয়নি। তাই নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট হওয়ার অযুহাতে মাহফিলের অনুমতি না দেয়াটা অন্যায়।’

পূর্ববর্তি সংবাদদিল্লির মাওলানা সাদ ভয়াবহ যে ৩টি সংকট তৈরি করেছেন
পরবর্তি সংবাদটঙ্গীতে তাবলিগ জামাতের উপর সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে কিশোরগঞ্জে বিক্ষোভ মিছিল