প্রশাসনের ভেতর হয়তো সাদপন্থী কেউ ঘাপটি মেরে আছে বা অন্য কোনো রহস্যজনক কারণে এমনটি হয়েছে : মাওলানা মামুনুল হক

মাওলানা মামুনুল হক। জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস ও খেলাফত যুব মজলিসের কেন্দ্রীয় সভাপতি। তার অন্যান্য গুণাবলীর সঙ্গে সময়ের নানা ইস্যুতে সাহসী উচ্চারণ তার ব্যক্তিত্বে বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। বয়সে তরুণ হলেও এই আলেম নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন নানাবিধ দ্বীনি কার্যক্রমে।

সম্প্রতি টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে সাদপন্থীদের নৃশংস হামলা, হামলার সময় বিভিন্ন পক্ষের ভূমিকা, হামলার পর সম্ভাব্য প্রভাব এবং করণীয়সহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন তিনি। ইসলাম টাইমসের পক্ষে তার সঙ্গে কথা বলেছেন আতাউর রহমান খসরু

ইসলাম টাইমস : আপনি ইতোমধ্যেই এই ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাই সেদিকে যাবো না। অন্য প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করি।  টঙ্গীর ইজতেমার মাঠে নৃশংস হামলার বিবরণ থেকে সহজেই বোঝা যায়, হামলাকারীরা মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের বিশেষ টার্গেটে পরিণত করেছিলো। কেন?

মাওলানা মামুনুল হক : তাদের বিভ্রান্তিগুলো আলেমরাই মানুষের সামনে তুলে ধরছেন। তাদের বয়ান-বক্তৃতায় সাদপন্থীদের দল হাল্কা হচ্ছে। তাবলিগের সাথীরা সত্য জানতে পেরে তাদের সঙ্গ ত্যাগ করছে। অধিকাংশই ফিরে এসেছে এবং বাকিরাও ফিরে আসবে খুব শীঘ্রই হয়তো। স্বাভাবিক কারণেই আলেমদের উপর তাদের ক্ষোভ কাজ করছে।

একই ভাবে আলেমদের অনুসারী হিসেবে ছাত্ররাও একই কাজ করছে। তাই আগামী দিনের আলেমদের উপরও তাদের ক্ষোভ রয়েছে।

 ইসলাম টাইমস : আলেমদের গায়ে নিঃসঙ্কোচে হাততোলার ঘটনা শুধু মাঠ দখলের প্রশ্নে হয়েছে। নাকি দীর্ঘদিনের কোনো বিশ্বাস ও চিন্তার চর্চার কারণে তাদের মন-মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটেছে। ফলে তারা অন্যায়কে অন্যায় মনে করছে না।

মাওলানা মামুনুল হক : এটা দীর্ঘদিনের প্রভাব বলেই মনে হচ্ছে আমাদের কাছে। যারা পূর্ব থেকে আলেম বিদ্বেষী ছিলো তারাই এখন মাওলানা সাদের অনুসারী হয়েছে। এখন তাদের বিদ্বেষ আরও বাড়ছে বা বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে আমরা বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি।

তারা যখন মাঠে ঢুকে পড়েছে তখন তাদের প্রতিরোধ করা হয়নি। তাদের প্রতিরোধ করার মতো কোনো আয়োজনও ছিলো না। মাঠে শুধু অবস্থানের বিষয় ছিলো। তারা মাঠে ঢোকার পর স্বাভাবিক দাবি ছিলো তারা তাদের আমল করবে। কিন্তু তা না করে তারা অবস্থানরত মুসল্লি, আলেম ও মাদরাসা শিক্ষার্থীর উপর হামলা করে বসলো। বিশেষত মাদরাসার কোনো শিক্ষক, সাধারণ আলেম, মসজিদের ইমাম বা খতিব তাদের চিনতে পারলে তাদের উপর মারাত্মক নির্যাতন করা হয়েছে। গুরুতর আহতদের অধিকাংশ হলেন মাদরাসার শিক্ষক বা মসজিদের ইমাম বা খতিব। এটা একটা ভয়ঙ্কর বিষয়।

এটা অবশ্যই রহস্যজনক বিষয়। মনে হচ্ছে, প্রশাসনের ভেতর হয়তো সাদপন্থী কেউ ঘাপটি মেরে আছে বা অন্য কোনো রহস্যজনক কারণে এমনটি হয়েছে। এটা পূর্ব পরিকল্পিত এবং ঠাণ্ডা মাথার হামলা বলা যায়। নতুবা এভাবে ধীরে ধীরে তাদের জমায়েত করলো। দায়িত্বশীলদের পুলিশ বললো, আপনারা ভেতরের দিকে চলে যান। আমরা এগারটার দিকে তাদের এখান থেকে উঠিয়ে দিবো। তাদের কথায় নূন্যতম পাহারাও শিথিল হয়ে যায়।

ইসলাম টাইমস : পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন।

মাওলানা মামুনুল হক : হ্যা, এটা অবশ্যই রহস্যজনক বিষয়। মনে হচ্ছে, প্রশাসনের ভেতর হয়তো সাদপন্থী কেউ ঘাপটি মেরে আছে বা অন্য কোনো রহস্যজনক কারণে এমনটি হয়েছে। এটা পূর্ব পরিকল্পিত এবং ঠাণ্ডা মাথার হামলা বলা যায়। নতুবা এভাবে ধীরে ধীরে তাদের জমায়েত করলো। দায়িত্বশীলদের পুলিশ বললো, আপনারা ভেতরের দিকে চলে যান। আমরা এগারটার দিকে তাদের এখান থেকে উঠিয়ে দিবো। তাদের কথায় নূন্যতম পাহারাও শিথিল হয়ে যায়।

সব মিলিয়ে বলা যায়, প্রশাসনের সহায়তা ও পরিকল্পনায় হামলার ঘটনা ঘটেছে।

ইসলাম টাইমস : সত্যিই যদি প্রশাসনের ভূমিকা থাকে সেটা কেন? সামনের নির্বাচনে সাদপন্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য?

মাওলানা মামুনুল হক : এটা আমার কাছে মনে হয় না। কারণ, সাদপন্থীরা এমনিতেই রাজনীতিতে নিষ্ক্রীয়। তাছাড়া তাদের উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা বা গণনাযোগ্য কোনো অবস্থান নেই।

আমার মনে হয়, অন্য কোনো পরিকল্পনা হয়তো হয়েছে। হয়তো প্রশাসনের কাউকে ম্যানেজ করেছে। বিপুল অর্থের লেনদেন এখানে হতে পারে। আমাদের সন্দেহ এজন্যই হয় যে, তারা হামলা পর থেকে বিকেল পর্যন্ত কিছুই করতে পারলো না। কিন্তু বিকেলে তাদের নিপীড়ন ও ধ্বংসযজ্ঞ শেষ করলো, তখন পুলিশ আধা ঘণ্টার মধ্যে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলো। এর আগে তারা কোথায় ছিলো?

প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় মানুষ তাদের ধিক্বার জানাতে শুরু করেছে। তাদেরকে তাবলিগের কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ দিচ্ছে না। অনেক জায়গায় তারা মসজিদে নামাজ পড়তে যায়নি। কারণ, তারা মুখ দেখাতে পারছে না।

ইসলাম টাইমস : আগামীর দিনগুলোতে এই ঘটনার কি কি প্রভাব পড়তে পারে?

মাওলানা মামুনুল হক : আমার মনে হয়, প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় মানুষ তাদের ধিক্বার জানাতে শুরু করেছে। তাদেরকে তাবলিগের কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ দিচ্ছে না। অনেক জায়গায় তারা মসজিদে নামাজ পড়তে যায়নি। কারণ, তারা মুখ দেখাতে পারছে না। অপরাধবোধ তাদের ভেতরে কাজ করছে।

ইসলাম টাইমস : আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামের কোনো দুর্বলতা ছিলো বলে আপনি মনে করেন?

মাওলানা মামুনুল হক : দেখুন! প্রশাসনের পক্ষ থেকে জমায়েত নিষিদ্ধ ছিলো। সাথীরা যারা ছিলো তারা কাজের জন্য ছিলো। পুলিশ বলছিলো, তারা নিরাপত্তার বিষয়টি দেখবে। সুতরাং এখানে আত্মরক্ষার বিষয়টি ছিলোই না।

তবে এতোটুকু বলা যেতে পারে প্রতিপক্ষ সম্পর্কে খুব বেশি সুধারণা আমাদের একটি ভুল ছিলো। শুক্রবার রাত থেকে তাদের আসার খবর শোনা যাচ্ছিলো তারা আসছে এবং সকাল থেকে তারা জড়ো হতে শুরু করে। তখন আমাদের আত্মরক্ষামূলক কিছু করা প্রয়োজন ছিলো। অবশ্য তাদের নৃশংসতা ও হিংস্রতা সব ধারণা ও কল্পনার বাইরে ছিলো। তাবলিগের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষ এতোটা হিংস্র হয় কি করে?

ইসলাম টাইমস : মাদরাসার ছাত্রদের তাবলিগের কাজ, তাদের রাজনৈতিক মিছিলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। আপনি বিষয়টি কিভাবে দেখেন?

মাওলানা মামুনুল হক : আমি বিষয়টিকে এভাবে দেখি যে, মাদরাসার ছাত্রদের প্রস্তুত করাই হয় আগামী দিনে দ্বীনি প্রয়োজন পূরণের জন্য। এখন যদি তাদের দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে সম্পৃক্ত করা না যায়, তাদেরকে যদি দ্বীনি আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা না যায় তবে তারা দ্বীনি কাজের জন্য প্রস্তুত হবে কীভাবে? হ্যা, তাদেরকে অবশ্যই ব্যক্তি স্বার্থে বা নিজস্ব কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করা উচিত হবে না।

ইসলাম টাইমস : সাদপন্থীদের এসব ধ্বংসাত্মক তৎপরতার উদ্দেশ্য কি?

মাওলানা মামুনুল হক : তাদের মূল উদ্দেশ্য আগামী বিশ্ব ইজতেমা হতে না দেয়া। কারণ, ইজতেমা হলে তাদের শূন্যতা বোঝা যাবে না এবং তারা নিজেদের যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে তাও সম্ভব হবে না। কারণ, ইজতেমার মাধ্যমে সারা দেশে উলামাদের বার্তা পৌঁছে যাবে। উলামায়ে কেরামের নেতৃত্ব স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। তারা আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে। ইজতেমা না হলে তারা বলবে, আমাদের ছাড়া তাবলিগের কাজ অচল।

এজন্য আগামীর ইজতেমা সফল করতে উলামায়ে কেরাম আরও সচেষ্ট হবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

ইসলাম টাইমস : এই মুহূর্তে তাবলিগি সাথী ও উলামায়ে কেরামের প্রতি আপনি কোনো আহবান জানাতে চান?

মাওলানা মামুনুল হক : আমার আহবান থাকবে সাদপন্থীদের ব্যাপারে আরেকটু সতর্ক হওয়া। তাদের গোরাহি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সাবধান তো করতেই হবে। তবে তা যেন কিছু্তেই সংঘাতের পর্যায়ে চলে না যায়। আমার ধারণা, উলামায়ে কেরামের কাজের গতি নষ্ট করতে, কাজের পরিবেশ ধ্বংস করতে ওরা আরও অনেক ফাঁদ তৈরি করতে পারে। মানুষ সচেতন হওয়ায় ওদের মিশন আগাচ্ছে না। তাই তারা চাইবে আমাদের কাজ বন্ধ করে দিতে। ইজতেমার মাঠের ঘটনা থেকে অন্তত তাই বোঝা যায়। প্রশাসনের কাছে তাদের প্রধান দাবিই ছিলো আমরা জোড় করবো না অন্যদের মাঠ থেকে বের করে দিন।

ইসলাম টাইমস : দীর্ঘ সময় দেয়ার জন্য ইসলাম টাইমসের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।

মাওলানা মামুনুল হক : ইসলাম টাইমস ও তার পরিবারকেও আমার মোবারকবাদ।

পূর্ববর্তি সংবাদসাদপন্থীদের হামলার প্রতিবাদে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বিক্ষোভ
পরবর্তি সংবাদবিএনপির আমানুল্লাহ আমানসহ ১৬৯ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা