মার্কিন বাহিনীতে দাড়ি ও হিজাবের অধিকার আদায়ে নওমুসলিম আবদুর রহমানের লড়াই

আতাউর রহমান খসরু ।।

মার্কিন ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিমান বাহিনীর একজন মুসলিম সৈনিককে তার ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষায় দাড়ি রাখার অনুমতি দিল। আর্মেনিয়ান বংশোদ্ভূত স্টাফ সার্জেন্ট আবদুর রহমান গিটান মার্কিন বিমান বাহিনীর ৮২১তম কনটেনজেনসি রেস্পন্স স্কোয়াড্রন-এর সদস্য। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার ট্রাভিস এয়ার ফোর্স বেইজে কর্মরত। দাড়ি রাখার অনুমতি চেয়ে দীর্ঘ অপেক্ষার পর দাড়ি রাখার অনুমতি পেলেন তিনি।

আবদুর রহমান গিটানের জন্ম একটি খ্রিস্টান পরিবারে। একজন ক্যাথলিক খ্রিস্টান হিসেবেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। তুরস্কের ইজমির বিমান ঘাঁটিতে দায়িত্ব পালনের সময় গিটান ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তুরস্ক ছেড়ে আসার পর ইসলামের ব্যাপারে তার কৌতুহল আরও বেড়ে যায়।

আবদুর রহমান বলেন, ‘আমি যখন তুর্কি ছেড়ে এলাম মনে হলো, আমি আমার খুব সামান্যই সঙ্গে নিয়ে ফিরতে পারলাম। আমি যেন আমাকে তুরস্কে ফেলে এসেছি। আমি কুরআন পড়তে শুরু করলাম। প্রতিদিনই আমার শেখার আগ্রহ বাড়ছিল এবং আমি কুরআন শেখার জন্য একটি রুটিন করলাম এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী কুরআন পাঠ এগিয়ে নিলাম।

আবদুর রহমান গিটান তুরস্ক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে বদলি হন। নিজের কৌতূহল দমন করতে না পেরে একদিন হাওয়াই-এর একটি মসজিদে যান তিনি। নিজের বিশ্বাস ও প্রশ্নগুলো তুলে ধরেন মসজিদের ইমামের কাছে। এভাবে কিছুদিন তার কাছে যাতায়াত করার পর তিনি ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন।

ইসলাম ধর্মগ্রহণ করার পর আবদুর রহমান নিজেকে এক মহাচ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত করলেন। চ্যালেঞ্জটি হলো, মার্কিন বাহিনীতে একজন ধার্মিক মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন করা। মার্কিন বাহিনীতে তার জন্য ধর্মপালনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সেভ না করে দাড়ি রেখে দেয়া।

দাড়ি রাখার আবেদনপত্র জমা দেয়ার প্রায় চার বছর পর আবদুর রহমান দাড়ি রাখার অনুমতি পেলেন। এইটুকু অনুমতির জন্য তাকে তার ইউনিট কমান্ডার থেকে শুরু করে বিমান বাহিনীর ডেপুটি চিফ স্টাফ অব পার্সোনেল ডিভিশন পর্যন্ত যেতে হয়েছে।

অনুমতি লাভ করতে আবদুর রহমানকে প্রমাণ করতে হয়েছে দাড়ি ইসলামি ধর্ম-বিশ্বাসের অংশ। তার এই প্রচেষ্টা শুধু তার দাড়ি রাখার অনুমতি এনে দেয়নি; বরং তা অন্যদের ধর্মপালনেরও পথ খুলে দিয়েছে। তার দাবি ও প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন সামরিক কর্তৃপক্ষ ধর্মপালনে নতুন নীতিমালা তৈরি করে। যাতে মুসলিম নারীদের জন্য স্কার্ফ এবং মুসলিম ও শিখ পুরুষদের জন্য দাড়ি রাখার অনুমতি দেয়া হয়। আর ওই বছরের এপ্রিল মাসে সৈনিকরা ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ হিসেবে দাড়ি বড় করার অনুমতি লাভ করে।

আবদুর রহমানও দাড়ি বড় করে রাখার অনুমতি পান। তখনকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, মুসলিমদের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে থাকবে। কারণ, এ অধিকার খুব সহজে আসেনি। আমি নানাভাবে বাধাগ্রস্থ হয়েছি এমনকি বিমান বাহিনীর সহকর্মীদের থেকেও অনেক অসহযোগিতা ও তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছি।’

‘এক মাস আগে আমি যখন দাড়ি বড় করতে আরম্ভ করি তখন কেউ কেউ আমাকে হাতের ইশারায় গুলি দেখিয়েছে, তারা অনেক বাজে মন্তব্য করেছে। কারণ আমি একজন মুসলিম। দাড়ি রাখার এক সপ্তাহ পর অন্য স্কোয়াড্রনের একজন আমাকে এমন একটি প্রশ্ন করে যে আমি বিব্রত হয়ে যাই। তিনি জানতে চান, আমি আইসিস-এ যোগ দিয়েছিলাম কিনা? এ বছরের শুরু দিকে আরেকজন প্রকাশ্যে জানতে চান আমি অতীতে সন্ত্রাসী ছিলাম কিনা?’

‘এটাও ঠিক যারা আমাকে বিব্রত করেছেন তাদের সংখ্যা খুব সামান্য। তাদের অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য দিয়ে সবাইকে বিচার করা যাবে না। কারণ, আমার সহকর্মীদের অধিকাংশ আমাকে ইসলাম লাভের পথে সহযোগিতা করেছে।’

সহকর্মীদের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ মনে রাখেননি আবদুর রহমান। তিনি বলেন, অনেক রূপালী স্মৃতি তাদের এই প্রতিক্রিয়া ভুলিয়ে দিয়েছে। যেমন, একবার আমি সিংহের মুখে পড়েছিলাম। একটি সিংহ আমরা আটক করে নিয়ে আসছিলাম। তখন পালের অপর একটি সিংহ আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু আমার এক নারী সহকর্মী তড়িৎ গতিতে তাকে গুলি করে হত্যা করে। আমি বেঁচে যাই। আমি আমার বাকি জীবন তার কাছে ঋণী হয়ে থাকবো।

আবদুর রহমান আরও বলেন, একদিন আমাকে আমার এক সহকর্মীসহ ইউনিট অফিসে ডাকা হলো। সে আমার দিকে গুলি করার ইঙ্গিত করেছিল। অফিসে ঢুকে দেখি আমাদের ইউনিট প্রধান ও ফার্স্ট সার্জেন্ট সেখানে অপেক্ষা করছেন। আমি বললাম, তার দৃষ্টি, কণ্ঠস্বর, শব্দ ও অঙ্গভঙ্গি আমাকে ব্যথিত করেছে। তারা বললেন, তুমি বিচার পেয়ে যাবে।

আমি বের হয়ে এলাম। আমি অনুভব করলাম আমি একজন স্প্যানিশ আর্মেনিয়ান মুসলিম নই; বরং আমি মার্কিন সামরিক পরিবারের একজন সদস্য। ভাবতে ভালো লাগে আমি শুধু ব্যাথাই পাইনি, আমার সহকর্মী ও আমার সিনিয়ররা আমাকে রক্ষার জন্য লড়াইও করেছেন।

উল্লেখ্য, ৫ জানুয়ারি ২০১৭ মার্কিন সামরিক অধিদপ্তর থেকে নতুন সামরিক নীতিমালা ঘোষণা করা হয়। তাতে বলা হয়, সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এখন থেকে দাড়ি রাখা এবং হিজাব পড়ার অনুমতি চেয়ে আবেদন করতে পারবে।

নীতিমালায় পরিবর্তন আনার কারণ হিসেবে বলা হয়, ২০০৯ সালের পর দাড়ি রাখা ও হিজাব পরার অনুমতি চেয়ে অসংখ্য আবেদন এসেছে তাদের কাছে। তারা গবেষণা করে দেখেছে দক্ষ সৈনিক হিসেবে গড়ে ওঠা এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্বপালনে হিজাব ও দাড়ি বাধা নয়; বরং ধর্মপালনে স্বাধীনতা সৈনিকদের জীবনে মানসিক স্বস্তি লাভের কারণ। একই সঙ্গে তা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধর্মপালনে স্বাধীনতারও প্রমাণ। ধর্মপালনে স্বাধীনতা সৈনিকের হীনমন্যতা দূর করবে।

কোনো সন্দেহ নেই মার্কিন সামরিক কর্তৃপক্ষের এই বোধোদয়ের পেছনে আবদুর রহমান গিটানদের মতো অসংখ্য মুসলিমের ত্যাগ ও বিসর্জনের ইতিহাস লুকিয়ে আছে। ইসলামের একটি বিধান পালন এবং একটি সুন্নাতের অধিকার আদায়ে আবদুর রহমানদের লড়াই যে শেষ পর্যন্ত মার্কিন সামরিক কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে সেটা কম বড় অর্জন নয়। বড় আরেকটি অর্জন হলো, প্রতিকূল পরিবেশে দ্বীন পালনের অধিকার আদায়ের চেষ্টা এবং তাতে সাফল্য লাভের নজির স্থাপন করা।

সূত্র : যুক্তরাষ্ট্রের ‘এয়ারফোর্সটাইমস’ অবলম্বনে

পূর্ববর্তি সংবাদবিশ্বব্যাপী মুসলমানদেরকে আমেরিকা ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান রুহানীর
পরবর্তি সংবাদহাকিম নড়লেও হুকুম যেন না নড়ে: নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে সিইসি