হাজার বছরের ওয়াজ-মাহফিল কীভাবে বন্ধ করবেন?

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর ।।

নির্বাচন উপলক্ষে ওয়াজ-মাহফিল এবং ধর্মীয় সভা করার ব্যাপারে ‘এক প্রকার নিষেধাজ্ঞা’ জারি করেছে নির্বাচন কমিশন। মাহফিল কেন বন্ধ করা হবে-এটা নিয়ে নানা মহলে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। তবে এই নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে উঁচুগলায় কেউ কিছু বলছে না। না গণমাধ্যম, না যারা ওয়াজ-মাহফিলে বক্তব্য রাখেন তারা কিংবা যারা বছরের পর বছর ধরে সারাদেশে মাহফিল করে থাকেন, তারাও মুখ ফুটে কিছু বলছেন না।

বিষয়টা নিয়ে ইসলামি নেতাদের যেভাবে কথা বলা উচিত সেভাবে অতটা বলছেন না। অথচ এ বিষয়টি নিয়ে তাদেরই সবচেয়ে সরব হওয়ার কথা। রাজনৈতিক অঙ্গনের অধিকাংশ ইসলামি নেতা মাহফিলকেন্দ্রিক ভালো বক্তাও। মাহফিল মৌসুমে তারা দেশব্যাপী ওয়াজ করে থাকেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের এমন অযাচিত হস্তক্ষেপে তারা অনেকটাই নীরব। কেন নীরব-সে বিষয়ও নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা ডিগবাজির ফাঁক-ফোকড়ে ঠাহর করা যাচ্ছে না। ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন আগে থেকেই মাহফিল আয়োজনকারী এলাকাবাসী। তাদের অসুবিধার বিষয়টি নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না।

ওয়াজ-মাহফিল নিয়ে নির্বাচন কমিশনের অজানা শঙ্কার কারণ কী-তার একটা ময়নাতদন্ত করা দরকার। এমন নয় যে এর আগে বাংলাদেশে ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে কোথাও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লাগানো হয়েছে। মাহফিলের ধর্মীয় বক্তারা মানুষকে ফুসলিয়ে কোনো মন্দির-গির্জা ভেঙেছে, এমন নজির বাংলাদেশে নেই। রাজনৈতিকভাবে প্রলুব্ধ করার বাণীও প্রচার করা হয় না এসব মাহফিল থেকে। তবুও মাহফিলের ওপর নির্বাচন কমিশনের এমন অবিবেচক খড়গের কোপ কেন পড়লো-এ বড় আশ্চর্যের বিষয়।

বাংলাদেশের শহর-গ্রামে যেখানে যত মাহফিল হয়, সেসব মাহফিলে ধর্মীয় বক্তারা যেসব বক্তব্য রাখেন, সেগুলো কোনোভাবেই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট কোনো বক্তব্য নয়। মানুষের জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধ, প্রাত্যহিক ঈমান-আমল, মাবা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ববোধ, স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সাংসারিক জীবন, সন্তান প্রতিপালন, সামাজিক অনাচার রোধে ধর্মের বাধ্য-বাধকতা… এসব বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়ে থাকে মাহফিলগুলোতে। এমন সমাজঘনিষ্ঠ ও প্রয়োজনীয় বিষয়ে সচেতনতামূলক জনসমাগম কেন নির্বাচন কমিশনের চোখে দৃষ্টিকটু মনে হচ্ছে, সেটাই দেশবাসী বুঝে উঠতে পারছে না।

এই যদি হয় দেশের নির্বাচন কমিশনের অবস্থা, যারা ধর্মীয় সভা বা মাহফিলকে রাজনৈতিকভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অন্তরায় মনে করে, সেই দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে আপনি তাকে দোষ দিতে পারেন না।

আরও পড়ুন : ‘নির্বাচন উপলক্ষে মাহফিলের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপের শামিল’

অধিক জনসমাগমের বিষয়টি যদি নির্বাচন কমিশনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে থাকে তাহলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাচ-গানের অনুষ্ঠান, কনসার্ট, ডিজে পার্টি বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় সভার ব্যাপারে কেন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি?

প্রশ্নটা আবারও এসে যায়-সমস্যাটা কোথায়? অধিক জনসমাগম, নাকি শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মীয় ওয়াজ-মাহফিল? যদি দেশের ৮৭ ভাগ মানুষের ধর্মীয় সমাগম রাজনৈতিক দোষে দুষ্ট বলে নির্বাচন কমিশন মনে করে, তাহলে দেশের সব মানুষই তো দোষী। কেননা, ওয়াজ-মাহফিলে হাজিরা দেয় না, বাংলাদেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। নিজ এলাকা বা পাড়া-মহল্লায় মাহফিল হলে ধর্মের কথা শোনার জন্য মহল্লার নারী-পুরুষ সবাই সেখানে অংশগ্রহণ করেন। এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সকলেই কি তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় দোষী সাব্যস্ত হবেন?

গ্রামে গ্রামে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন বাংলাদেশের হাজার বছরের সংস্কৃতি। বলতে গেলে এটা বাংলাদেশে ইসলামের একটি সাংস্কৃতিক নোঙর। কেননা, বাংলাদেশে ইসলাম প্রসার ঘটেছে বিভিন্ন পীর-আউলিয়া, দরবেশ-মৌলানা আর হুজুরদের দরাজ বয়ানের মাধ্যমে। কোনো বীরযোদ্ধা বা দুর্বার সিপাহসালারের রণহুঙ্কারে বঙ্গ অঞ্চলে ইসলাম প্রসার লাভ করেনি।

যেসব মুসলিম সেনাপতি বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চল জয় করেন, তারা ধর্মপ্রচারের জন্য আসেননি। তারা এসেছিলেন রাজ্যজয়ের জন্য। তারা কেবল স্থানে স্থানে সিপাহী দিয়ে কিছু রাজ্যই জয় করেছেন, কিন্তু ইসলামের বিচ্ছুরিত আলোকবিভা দিয়ে বঙ্গের মানুষের মন জয় করেছেন দরবেশ-ফকির, পীর-আউলিয়া, মৌলানা আর হুজুররা। তারা ইসলামের বাতি হাতে ছুটে গিয়েছেন অন্ধকার আর নিষ্পেষণে ডুবন্ত মানুষের দ্বারে দ্বারে। মানুষকে শুনিয়েছেন ধর্মের কথা, এক আল্লাহর কথা, রাসুলের কথা, তাঁর অনুপম জীবনচরিতের কথা। তাদের কথায় প্রভাবিত হয়েই আজকের বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বলে বিশ্বের বুকে গর্ব করতে পারে।

এই ধারাবাহিকতা আজও  চলমান। রাজনীতির কূটচাল কিংবা সমরযজ্ঞ নয়, ধর্মের শান্তির বারতা নিয়ে এই মাওলানারাই নিরাপদ আর সুরক্ষিত রেখেছে বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। বাংলার প্রতিটি জনপদে নিভৃতে জ্বলতে থাকা মাদরাসাশিক্ষা, মসজিদের মিম্বার থেকে ধ্বনিত হওয়া ইমাম সাহেবের বয়ান, ওয়াজ-মাহফিলের মাইকে বেজে ওঠা মাওলানা আর মুফতিদের দরদি কণ্ঠ-এইসব মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষরাই যুগ যুগ ধরে ইসলামের বাতিঘর কাঁধে করে বয়ে এনেছেন। এ মাহফিল সংস্কৃতি তাদেরই হাজার বছরের অবদান।

শত সহস্র বছর ধরে তাই ওয়াজ-মাহফিলও আমাদের মুসলিম সমাজে একটা ধর্মীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের মাহফিল সংস্কৃতি অনেকাংশেই ভিনদেশি অপসংস্কৃতিকে বিদূরিত করতে ভূয়সী অবদান রেখে আসছে। মাহফিল সংস্কৃতির কারণেই আজ বাংলাদেশে যাত্রা ও অশ্লীল নৃত্যের সংস্কৃতি সমূলে উৎপাটিত প্রায়। এ অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

বাংলাদেশে যারা সংস্কৃতি নিয়ে জোর গলায় কথা বলেন, বাঙালি সংস্কৃতির ধ্বজা উড়িয়ে বেড়ান, তাদের সংস্কৃতির তালিকায় নানা ভেদ-মারফত, নাচন-কুর্দন, পশুপাখি-বিড়াল-খাটাশের জায়গা হলেও সে তালিকায় কখনো ওয়াজ-মাহফিলের জায়গা হয় না। তারা হাজার বছরের এই গ্রামীণ মাহফিল-জলসাকে বাঙালির সংস্কৃতি মনে করতে বরাবর নাপছন্দ করেন।

বছরে একদিনের পহেলা বৈশাখ নিয়ে আমাদের সংস্কৃতিমনারা হৈ হৈ রৈ রৈ করে থাকেন, কিন্তু বছরের প্রতিটা দিন যে ওয়াজ-মাহফিল চলে আসছে শত শত বছর ধরে, সেই মাহফিল বাঙালির সংস্কৃতিতে অচ্ছুৎ। হিন্দু সংস্কৃতি হলেই সেটা ‘বাঙালি সংস্কৃতি’র হালখাতায় ওঠে, মুসলিম সংস্কৃতি হলেই সেটা কেন হুলো বেড়াল হয়ে যায়-এই অবোধগম্য অংক বাঙালি আজও ‍বুঝলো না।

পূর্ববর্তি সংবাদযারা শুধু উপায়-উপকরণের ওপর ভরসা-বিশ্বাস করবে, সৃষ্টিজগৎ তাদের বিরুদ্ধাচারণ করবে
পরবর্তি সংবাদক্রিকেট খেলা নিয়ে পাকিস্তানে সংঘর্ষে নিহত ৭