শেষ সময়েও নিজেরা এক হলে ভালো কিছু করা সম্ভব

মাত্র কয়েক মাস আগেও আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইসলামি দলগুলোর যে ‘বিপুল মূল্যায়ন’ বড় দলগুলোর কাছে দেখা যাচ্ছিলো, তা যেন হঠাৎ-ই অধরা হয়ে গেল। জোটবদ্ধ হওয়ার সময়কার অনেক হিসাব এখন আর মিলছে না। হতাশা দেখা দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় ধারার সঙ্গে জোটবদ্ধ ইসলামি দলগুলোতে। তাদের কারো কারো আচরণে নানানভাবে প্রকাশ পাচ্ছে তার প্রতিক্রিয়া।

ইসলামি দলগুলো আপাত দৃশ্যমান সংকটের কারণ ও উত্তরণের উপায় বিশ্লেষণ করেছেন ইসলাম টাইমস সম্পাদক শরীফ মুহাম্মদ। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন আবরার আবদুল্লাহ

ইসলাম টাইমস : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে পরিবেশ কেমন মনে হচ্ছে আপনার?

শরীফ মুহাম্মদ : নির্বাচন নানা কারণে এবার আমার কাছে একটু বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মনে হচ্ছে। কারণ, সব দলের অংশ গ্রহণ, সংসদ না ভাঙ্গা, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও আবার সাড়া জাগানো একটা প্রস্তুতি নেওয়া ইত্যাদি। এ বিষয়গুলো আমার কাছে বিশেষভাবে লক্ষণীয় মনে হয়। নির্বাচনের কয়েক মাস আগ থেকেই দাবি-দাওয়া, উত্তেজনা আমরা লক্ষ্য করেছি। যদিও বড় ধরণের কোনো দুর্ঘটনা -আশপাশের দেশে যেমন ঘটে- ঘটেনি। আল্লাহ হেফাজত করেছেন।

ইসলাম টাইমস : এবারের নির্বাচনে ইসলামি দলগুলোর অবস্থান কেমন?

শরীফ মুহাম্মদ : ইসলামী দলগুলোর কথা যদি বলি তাহলে বলব গত তিন চার মাসেও মনে হয়েছিল যে ইসলামী দলগুলো যথেষ্ট মূল্যায়নের মধ্যে আছে। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকেও এবং বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকেও। কিন্তু নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে এবং আসন বন্টনের ব্যাপার সামনে আসছে ইসলামী দলগুলোর ছড়িয়ে ছিটেয়ে থাকা রূপটা তত প্রকাশ্ পাচ্ছে। এই রূপটা যত প্রকাশ্ পাচ্ছে ততই আমার মনে হচ্ছে তাদের গুরুত্ব কমছে।

মানুষ সম্ভাবনার ভিত্তিতে ধারণা করতো, এদিক থেকে বা ওদিক থেকে এতগুলো আসনে ইসলামী দলগুলো বিজয়ী হতে পারত। কিন্তু এখন দুইটা আসনের কথাও সামনে আসে না। যেখানে সম্ভাবনার ভিত্তিতে বলা যায় নৌকা বা ধানের শীষ বা অন্য কোনো প্রতীকে নির্বাচন করলেও তারা বিজয়ী হবে। এ্ই অবস্থাটা কিন্তু ইসলামি দলের প্রার্থীদের দুই মাস আগেও ছিল না।

দুই মাস আগে আমাদের মনে হতো, ১৫-২০টা আসন বিজয়ী হতে পারবে আমাদের লোকেরা। কিন্তু রাজনীতির নানা মেরুকরণ- বিএনপির বা আধা ডানরা বামের দিকে যাওয়া, সেক্যুলারপন্থী দলগুলোর কিছু নামকরা ইসলামি দল, কিছু মাজারপন্থী কথিত ইসলামি দলগুলোর একটা বিশাল সিরিয়াল তাদের সঙ্গে নেওয়া; মানে এই উল্টামুখী যাত্রার কারণে আমাদের কওমি মাদরাসা ভিত্তিক দলগুলোর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রূপটা প্রকট হচ্ছে এবং এখানে আমার কাছে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়েছে।

ইসলাম টাইমস : নির্বাচনে মহাজোটের সহযাত্রী একটি দল বলেছে, ২-৩টি আসন পেলেই তারা মহাজোটে থেকে যাবে। এটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

শরীফ মুহাম্মদ : আসলে এটাকে অতিরিক্ত নির্ভরতা বা দুনিয়াদার দলগুলোর সাথে কৌশলের কিছুই হাতে না রেখে আত্মসমর্পণের একটা ফল বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের বাস্তবতা তো এই জায়গায় ছিল না! এই দুই সিটের মনোনয়ন দিলেই যে পাশ করবে তার নিশ্চয়তা কে দিবে? আত্মসমর্পণের এই ধারা যদি চলতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে হতাশা আরও বাড়বে।

ইসলাম টাইমস : জোটবদ্ধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইসলামি দলগুলো দুটি বিষয় খুব জোর দিয়ে বলতো। সংসদে আলেমদের প্রতিনিধিত্ব সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করবে এবং জোটবদ্ধ হলে ইসলামের পক্ষের আওয়াজ উঁচু হবে। এই সম্ভাবনা দুটি শেষ হয়ে যাচ্ছে?

শরীফ মুহাম্মদ : আমি বলি না, সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাচ্ছে তবে আসন্ন নির্বাচনের পরিস্থিতি এই মুহূর্তে যে জায়গায় আছে, আমার কাছে মনে হয় না যে, এমন কোনো জায়গায় ইসলামি দলগুলো আছে। উভয় বড় জোটের সাথে ইসলামি দলগুলো যোগ দিয়েছে বা যোগ দেওয়ার কথা চলছে, সেখানে তারা ব্যাক বেঞ্চার হিসাবে আছে। মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও তারা পেছনের সারিতে। গণনার ক্ষেত্রেও পেছনের সারিতে। পদমর্যাদার ক্ষেত্রেও তারা পেছনের সারিতে। আসনের ক্ষেত্রেও অনিশ্চিত।

এমন পরিস্থিতিতে ইসলামি মূল্যবোধ প্রকাশ পাবে, ৩ জন বা ৫ জন আলেম সংসদে গেলে ইসলামের মর্যাদা প্রকাশ পাবে সেটা আরও অনেক দূরের ব্যাপার। ব্যাক বেঞ্চার অবস্থায় থেকে যদি পাসও করে, তবুও তারা জোটগুলোর যারা নিয়ন্ত্রক তাদের কাছে একেক জন গুরুত্বহীন ব্যক্তি হিসাবেই  থাকবে। পাস করলেও আদর্শ পরিচয়হীন একজন এমপির চেহারা নিয়ে তারা সংসদে ঢুকবে। এর চেয়ে বেশি এখন আমার কাছে কিছু মনে হয় না। যদি হয় তাহলে আমার ধারণার বাইরে ঘটবে।

ইসলাম টাইমস : ড. আ ফ ম খালিদ হোসাইন ইসলামি দলগুলোর আজকের অবমূল্যায়নের পেছনে একটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তাহলো, সাধারণ ও ইসলামি দলের চূড়ান্ত লক্ষ্য এক হয়ে গেছে। তাহলো, ক্ষমতা লাভ।

শরীফ মুহাম্মদ : আমি তার বিষয়টার সঙ্গে আরেকটু সংযোজন করি। উনি সমঝদার বিজ্ঞ মানুষ। আমি বলব, বড় বড় জোটগুলোর সাথে থাকার ক্ষেত্রে আমাদের যে বডি লেংগুয়েজ বা শরীরি ভাষা, আদর্শিক দিকের সাথে নিজেদের গুরুত্বটাকে স্থাপন করা, বার্গেনিং যথাযথভাবে করতে পারা এই জায়গাগুলোও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।

দুটি জিনিসই দরকার, আদর্শিকভাবেও স্বাতন্ত্র্য দরকার  আবার  বডি লেংগুয়েজ, বার্গেনিং, আচরণগত মর্যাদার দিকেও ভিন্নতা থাকা দরকার।

ইসলাম টাইমস : এখন নির্বাচনের হিসাব শেষ করার সময় হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে এসে ইসলামি দলগুলোর কী করার আছে?

শরীফ মুহাম্মদ : আমি এই প্রশ্নটাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন মনে করছি। অনেক দেরি হয়ে গেছে ঠিক। তারপরও যদি বড় বড় জোটের কাছে তারা প্রত্যাশার ঝুলি নিয়ে না ঘুরে যে কয়টা প্রভাবশালী ইসলামি দল বাংলাদেশে আছে, তারা এক দিন বা এক রাত; চব্বিশ ঘণ্টা এক সাথে বসে যান তাহলে সমাধান বের হওয়া সম্ভব। আমি নাম ধরে বলব ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের দুই গ্রুপ, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন যদি এক সাথে বসে যান এবং ঠিক করেন পঞ্চাশটা আসনে তারা পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে শুধু ইলেকশনটা করবেন। আসনগুলো সম্ভাবনার ভিত্তিতে ভাগ করে নেওয়া হয়, তবে আমার কাছে মনে হয় একটা নতুন দিগন্ত উঠে আসতে পারে।

আদর্শের উপরে থেকেই দশ জন এমপি চলে আসতে পারে। আরেকটা হলো তারা এ রকম পঞ্চাশটা সিটে ড্রাইভ দেয় তাহলে বড় দলগুলো আওয়ামী লীগ হোক বা বিএনপি তারা অন্য সিটগুলোর ব্যাপারে এক ধরনের লিয়াজোঁ করতে আসতে পারে। তখন তারা একটা নির্বাচনী লিয়াজোঁ করতে পারে সেটা হলো সেকেন্ড লিয়াজোঁ। দ্বিতীয় ধাপের লিয়োজোঁ। তারা দরকার ও উপযোগিতা দেখে বড় কোনো জোটের সাথে আড়াইশ সিটে লিয়াজোঁ করে পঞ্চাশটা সিটে নিজেরা সর্ব শক্তি নিয়োগ করে পাগলের মত ড্রাইভ দিতে পারে।

এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন নিল ১০-১২টা জমিয়ত নিল ৭-৮টা, খেলাফত মজলিস নিল ৬-৭টা। এভাবে অন্য দলগুলিও নিল। প্রতীকও তারা এক করে ফেলতে পারে বা ভিন্ন প্রতীকও হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে যে একেক আসনে আমাদের নেতারা একেক  প্রতীক সামনে নিয়ে অগ্রসর হবেন। একটা অস্থায়ী মোর্চাও করে ফেলতে পারেন তারা। ইসলামি দলগুলির নির্বাচনী মোর্চা।

ইসলাম টাইমস : রাজনৈতিক দলগুলোর ঘাড়ে নির্বাচনের শ্বাস পড়ছে। এখন এই মোর্চা হওয়া সম্ভব?

শরীফ মুহাম্মদ : আমি মনে করি সম্ভব। মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের আগের দিন পর্যন্ত সম্ভব। যদি এখনো পঞ্চাশটা আসন টার্গেট করে সময় যাওয়ার আগে, প্রত্যাহার করা বা সমর্থন ব্যক্ত করার সময় সীমার আগে যদি বসা যায় তাহলে আমার মনে হয় এই ইলেকশনে তারা একটা মর্যাদার জায়গায় চলে যেতে পারবে।

ইসলাম টাইমস : অনেকেই মনে করেন, ইসলামি দলগুলোর বৃহত্তর ঐক্যের পথে ‘একক নেতৃত্ব’ প্রতিষ্ঠা একটি বড় বাধা। নির্বাচনী মোর্চার ক্ষেত্রে সে প্রশ্নের সমাধান কীভাবে হবে?

শরীফ মুহাম্মদ : আমার মতো রাজনীতির বাইরে থাকা মানুষের পক্ষে এ বিষয়ে ভাল উত্তর দেওয়া কঠিন। আমরা আমাদের  কৈশোরে-যৌবনে দেখেছি খতিব ওবায়দুল হক রহ. এ ক্ষেত্রে সালিসের ভূমিকা পালন করতেন। আল্লামা আহমদ শফীও কখনো কখনো অরাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছেন। তারা সংগঠনমুক্ত ছিলেন। এখনও যদি যারা রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর বাইরে এবং গুরুত্বপূর্ণ সকল মহল মান্য করে এমন ২ জন বা ৩ জন  আলেম, বরেণ্য ব্যক্তিকে মেনে যদি বৈঠক শুরু হয় তাহলে চব্বিশ থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে একটা ভাল ফলাফল আসতে পারে।

এরকম একটা প্যানেলকে অনুরোধ করে সালিস মেনে আসনের নকশা ও গ্রাফটা নিয়ে যদি বসা যায়, তাহলে একটা ফলাফল আসতে পারে। হয়তো কোনো দল বলবে, আমার এতটা আসন চাই, আরেক দল বলবে, আমার এতটা আসন চাই। তারপরও মনে হয় একটা সমঝোতায় যাওয়া যায়।

ইসলাম টাইমস : বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক আজ ইসলামি দলগুলোকে ‘এক আসনে একজন ইসলামি দলের প্রার্থী’ নীতি অনুসরণের আহবান জানিয়েছেন। আপনার প্রস্তাবের সঙ্গে এই প্রস্তাবের মিল-অমিল কতোটুকু?

শরীফ মুহাম্মদ : আমি যে প্রস্তাব দিয়েছি তার প্রথম ধাপ সেটি। মাওলানা মাহফুজুল হক যদি একথা বলে থাকেন তাহলে আমি ইসলামী নির্বাচনী মোর্চার যে কথাটা বলেছি, সেটা আসলে তার প্রথম ধাপ। কিন্তু ওখানে থেমে থাকলে পুরোপুরি সুফল অর্জন করা কঠিন হবে। এর আগে একটা মিটিং হওয়া দরকার। এর আগে একটা জোট হয়ে গেলে একটা সমঝোতা হয়ে গেলে জোটের আকৃতি ধারণ করবে। তখন এ জাতীয় সিদ্ধান্ত পালন করা সহজ হবে।

পূর্ববর্তি সংবাদনির্বাচনের আগে আর কোনো ওয়াজ-মাহফিল নয় : ইসি
পরবর্তি সংবাদকারওয়ান বাজার সবজির আড়তে আগুন