আর্থিক, রাজনৈতিক, মতাদর্শিক দিক দিয়ে থর থর করে কাঁপছে পৃথিবী

ড. মাহফুজ পারভেজ ।। 

আমেরিকার নামজাদা স্ট্যানফোর্ড স্কলার ইয়োশিহিরো ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা নানা কারণে বিখ্যাত। সমকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে তাঁকে অন্যতম শ্রেষ্ঠজন বলে গণ্য করা হয়।

এই ভদ্রলোকের নাম আমরা প্রথম জানতে পারি, গত শতাব্দীরর নব্বই দশকে। যখন বার্লিন দেয়াল ভেঙে দুই জার্মানি এক হচ্ছে, পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক বলয়ের দেশগুলো ধ্বসে পড়ছে এবং খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল দুর্গের পতন ঘটছে, তখন তিনি একটি নতুন বই হাতে ঢুকে পড়লেন বিশ্বরাজনীতির রঙ্গমঞ্চে।

সালটা ছিল ১৯৯২। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পতনের উল্লাসে পুঁজিবাদী পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকা তখন তালিয়া বাজাচ্ছে। তখন  ফুকুয়ামার যে বই হৈচৈ ফেলে দেয়, তার শিরোনাম ছিল ‘এন্ড অফ হিস্ট্রি অ্যান্ড দি লাস্ট ম্যান’।

গভীর আবেগ ও উচ্ছ্বাসে তাতে ফুকুয়ামা লিখেছিলেন ইতিহাস শেষ। এখন শুধু পুঁজিবাদ আর পশ্চিমা উদার গণতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই চলবে না। তাঁর বিখ্যাত উক্তি ছিল এই রকম:

“What we may be witnessing — is the end point of mankind’s ideological evolution and universalisation of Western liberal democracy as the final form of human government.”

এহেন ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা গত ১৭ অক্টোবর ‘নিউ স্টেটসম্যান’ নামে একটি মার্কিন সংবাদপত্রকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বলছেন বিপরীত কথা।

সবচেয়ে মজার বিষয় হল, মাত্র ২৬ বছরের ব্যবধানে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা আর ইতিহাসের শেষটা দেখতে পাচ্ছেন না। ১৯৯২ সালে যেখানে ইতিহাসের শেষ দেখতে পেয়েছিলেন, সেই জায়গাটি যেন বড় ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে ৬৫ বছর বয়সী এই পুঁজিবাদী রাজনৈতিক ভাষ্যকার বললেন, “সমাজতন্ত্র আবার ফিরে আসবে। শুধু আসবে বললে ভুল হবে, অবশ্যাম্ভাবীভাবেই ফিরে আসবে।”

কোন পরিপ্রেক্ষিত থেকে এই ঘোরতর উপলব্ধি হল ফুকুয়ামার? সহজভাবে বলা যায়, বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের নয়া সঙ্কটই তাঁকে এই ধারণায় উপনীত হতে কার্যত বাধ্য  করেছে। তাঁকে বলতে হচ্ছে বণ্টনে বৈষম্যের কথা, উৎপাদন প্রক্রিয়া তথা সমাজ থেকে শ্রমজীবী মানুষের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা।

কেন এই কথাগুলি বলতে বাধ্য হচ্ছেন ফুকুয়ামা? তিনি তো বলেছিলেন, পুঁজিবাদ এখন উত্তর-পুঁজিবাদী পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। পুঁজিবাদের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে গিয়েছে। এই বিকাশের ক্ষেত্রে যে সমস্ত বাধা আসবে, তার জন্য খুচরো যুদ্ধ-টুদ্ধ করতে হতে পারে। সেটা স্যামুয়েল পি হান্টিংটন কথিত “ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশন”।

তিনি  আরও বলেছিলেন, “অসামান্য জীবন ও ব্যক্তিমানুষের চূড়ান্ত স্বাধীনতা আসবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে ব্যক্তিমানুষের যাবতীয় পছন্দ। বাজারই বলবে শেষ কথা। কোথাও কোনও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। পুঁজিই হবে মূল নিয়ন্ত্রক। বাঁচার অধিকার তাদেরই থাকবে, যারা ফিটেস্ট। সামাজিক সুরক্ষার ন্যূনতম বালাই রাখার কোনও প্রয়োজন নেই। অবাধ বাণিজ্যে অপরিসীম মুনাফা। এটাই শেষ কথা।”

কিন্তু বাস্তবে শোষণ ও বৈষম্য বেড়েছে। মানুষের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। বিশ্বব্যাপী চলমান ছোট্ট ছোট্ট সংঘাতের যোগফল মহাযুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতিকেও ছাড়িয়ে গেছে। পরিস্থিতি এতোটাই বিগড়ে গেছে যে, পণ্ডিত লোকটি পর্যন্ত তাঁর আগের কথা বদলে দিয়ে উল্টা কথা বলছেন!

একদা পুঁজিবাদের একচ্ছত্র সাফল্য ও বিজয় ঘোষণাকারী পণ্ডিতের কথা ব্যর্থ হয়েছে। ‘আবার সমাজতন্ত্র আসবে’ মর্মে তাঁর আশাবাদও ব্যর্থ নাকি সফল হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে তাঁর আগের ও এখনকার কথার মাঝ দিয়ে এ সত্য বিলক্ষণ টের পাওয়া যাচ্ছে যে, পৃথিবীর পরিস্থিতি ভালো নেই। আর্থিক, রাজনৈতিক, মতাদর্শিক দিক দিয়ে থর থর করে কাঁপছে পৃথিবী। অবিরাম ঝরছে রক্ত। বিনাশ হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ।

ফুকুয়ামা সভ্যতার ইতিহাসের কাছে মর্যাদা পেতেন, যদি তিনি তাঁর দেশে এবং তাঁর চারপাশে অবস্থিত বিশ্ব সভ্যতা ও মানবতার হন্তারকদের চিনিয়ে দিতেন। কোনও মতাদর্শ আসা বা না আসার আগে চেনা দরকার, কাদের কারণে ভালো নেই পৃথিবী এবং এই সবুজ পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ।

পূর্ববর্তি সংবাদজিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদার জামিন চেয়ে আপিল
পরবর্তি সংবাদএকজন নেতা সফলতার কৃতিত্ব অধীনস্থদের দেয়