মিশরের অবাক সৈকতে

সালমান মাহবুব ।।  আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে

মিশর নামটি শুনতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম সুউচ্চ পিরামিড ও ফারাও সাম্রাজ্যের কথা। মনের চোখে ঢেউ তোলে হযরত ওমর রা.-এর প্রেরিত পত্রাদেশে প্রবাহিত হওয়া নীলনদ।  হাজার বছরের ইলম ও জ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয় আল-আযহারের প্রাঙ্গণ। এ ছাড়াও প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সভ্যতার এ দেশটিতে রয়েছে বহু মূল্যবান স্থাপনা ও প্রাচীন নিদর্শন। আছে বহু মনীষীদের সমাধি।

মিশর তাই সমগ্র বিশ্বজুড়ে এক বিস্ময়। গবেষক ও পর্যটকদের জন্য অন্যতম পছন্দনীয় দেশ। ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগর বেষ্টিত এ দেশটির সমুদ্র তীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বর্ণনাতীত। প্রবাসে শিক্ষাজীবনে স্বজনহীন একাকিত্ব ও ব্যস্ত জীবনের একগুয়েমি কাটিয়ে তুলতে সাগর দেখার আয়োজন করল আলআযহারে অধ্যয়নরত বাংলাদেশী ছাত্র সংগঠন- বাংলাদেশ স্টুডেন্টর্স অর্গানাইজেশন। আমাদের ঘুরতে যাওয়া স্থানটির নাম মারসা মাতরুহ। মিশর সীমান্তে আর লিবিয়ার বর্ডার নিকটবর্তী ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী সমুদ্র সৈকতের এলাকা। সৈকতটি ‘সাতি’ আজিবা’ (আজব সৈকত) নামে পরিচিত।

ঘড়িতে রাত তখন ১১ টা। ২৫ অক্টোবর ২০১৮। স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের উদ্যোগে আয়োজিত রিহলাতে আমরা ভূমধ্য সাগর তীরে আজিবা সৈকতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। পঞ্চাশ জনের কাফেলা। কায়রো থেকে প্রায় ৫০০ কি. মি. দূরত্ব। ফজরের নামাজ সৈকতে গিয়ে আদায় করার ইচ্ছে আমাদের।

ভাবছিলাম সফরটা দিনের বেলায় হলে যাত্রাপথে মরুদৃশ্যের অপরুপ সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হতাম। কিন্তু সফর এক দিনের। রাতে গিয়ে পরের রাতেই ফিরতি। তাই গাড়িতে উঠে কিছুক্ষণ খোশগল্প। তারপর অনেকেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে। আমি একটু চিন্তিত মনে বসে আছি। সফরে গাড়িতে আমার ঘুম আসে না। তবুও চোখ বন্ধ করে ঘুমের চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। ফলাফল যা ভেবেছিলাম তাই। চেষ্টা-তদবির করেও ঘুমের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল না।

অগত্যা বসে বসে জানালার কাঁচের বাইরে দ্রুত বেগে পিছনে ছুটে যাওয়া লাইটের আলোর দিকে তাকিয়ে নানা কিছু ভাবছিলাম। অন্ধকারে লাইটের আলোবিহীন দূরে আর কিছু দেখা যায় না। নগর পেরিয়ে রাতের নিস্তবদ্ধতা ছিন্ন করে অন্ধকার মরুপথে প্রবেশ করছিলাম আমরা। গাড়িতে ততক্ষণে প্রায় সকলেই সিটের কোলে গভীর ঘুমে নিমগ্ন।

অনেকটা পথ চলার পর রাত ৪ টার দিকে হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল। ইঞ্জিন বিকল! সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়! আরও প্রায় ২০০ কিলোমিটারের পথ বাকি। অন্য একটি গাড়ি ব্যবস্থা করা হলো। অপেক্ষা করতে হবে কিছু সময়।

গাড়িতে বসেই বাইরে দেখছিলাম। হাইওয়ে রোড। থেমে থেমে এক-দুটি গাড়ি শা শা করে চলে যাচ্ছে। চারদিকে মরুভূমি। বেশ দূরে কিছু লাইটের আলো দেখা যায়। চাঁদনী রাত। পরিষ্কার আকাশের মেঘগুলো অজানা গন্তব্যের দিকে পাড়ি জমাচ্ছিল। রাতের দৃশ্যটা ভালো করে উপভোগ করতে গাড়ি থেকে নামলাম। সাথে সাথেই একটা শীতল ঠাণ্ডা বায়ু শরীর মন জুড়িয়ে দিয়ে গেল। মুহূর্তটার অনুভূতি ভোলার নয়। তিক্ত সময়ের অন্যরকম মিষ্ট অনুভূতি।

সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। ফজরের আজান হয়ে গেছে। পিছনে অল্প দূরে টোলবক্সের পাশে একটি নামাজের জায়গা। নামাজ পড়ে বেরিয়ে এসে মনে হলো অপরূপ চারপাশ। ভোরের নীলচে আভায় এত সুন্দর সকাল আর মনোরম আবহাওয়া! মনে প্রশান্তি বইয়ে দিলো। মৃদুমন্দ বাতাসে রাস্তার পাশে হালকা পায়চারি করে গাড়িতে ফিরলাম। সারা রাত জাগ্রত। ভাবলাম, বাস আসা পর্যন্ত একটু ঘুমিয়ে নিই। আধো আধো ঘুম। অল্পক্ষণ পর উঠে গেলাম। অপেক্ষার সময়কে কাজে লাগাতে ওদিকে আরেকদল ব্যাট বল নিয়ে মরুভূমির শুষ্ক বালির মাঠে টাইগারদের ভূমিকা পালন করছে। ওদের দর্শক হলাম কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ?

গাড়ী তো আসছে না! অপেক্ষার সময় কাটতে চায় না। মরুভূমির বুকে এভাবেই কাটল আট ঘন্টা। কায়রো থেকে গাড়ি এসে পৌছাল সকাল ১১ টায়। যেন সাহারা মরুতে হারানো উটের সন্ধান। সবার মুখে আনন্দের হাসি। অবশেষে অপ্রত্যাশিত জায়গায় অনাহুত এক দীর্ঘ বিরতির সমাপ্তি ঘটল। ফের নতুন উদ্যমে রওনা হলাম মারসা মাতরুহের দিকে।

তিন ঘন্টা পর আমরা পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। সবার পেটে ভীষণ ক্ষুধা। লাঞ্চ শেষে এদিক-ওদিক একটু ঘোরাঘুরি। তারপর ছুটে গেলাম সমুদ্রের তীরে। অসীম সমুদ্র তার বিশালতা দিয়ে সবার মনে শূন্যতা  আর নিস্তব্ধতার এক অজানা অনুভূতি সৃষ্টি করে।

একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না- অবশেষে আমরা আজিবার সৌকতে!  ভেতর থেকে বের হয়ে আসা বাঁধভাঙা উল্লাস আর আনন্দ-চিৎকার থামাতে পারছে না অনেকেই। সাগরের তীর ঘেঁষে পাথুরে পাহাড়ি এলাকার নৈসর্গিক দৃশ্যে চোখ আটকে যায়। প্রাকৃতিকভাবেই পাহাড়ের গায়ে খোদাইকৃত চমৎকার অঙ্কন শৈলী! যেন সাগরের কিনারায় পাহাড়ের বুকে ছোট ছোট সংখ্যাতীত তরঙ্গের ঢেউ। মহান আল্লাহ যেন তাঁর কুদরতি নিপুণ হাতের তুলি দিয়ে নিখুঁত সাজে সাজিয়েছেন। এমন জাদুকরী রূপের কারণেই সৈকতটির নামকরণ- ‘আজিবা-আশ্চর্যময়।’

ঝিরঝির ঠাণ্ডা বাতাস। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র। বসে আছি বালির ওপর। পাহাড়সম উঁচুতে মহা গর্জনে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে সাগর কূলে। যতবারই দেখি বুকের ভেতরটা ভরে ওঠে। ঢেউ আসছে সাদা ফেনা নিয়ে। চলে যায় আবার ফিরে আসে। চেয়ে থাকি অবাক হয়ে। এ বিশালতার কাছে কত ক্ষুদ্র আমরা!   মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট এ ক্ষুদ্র-বিশালতার কাছে আমাদের সবকিছু কতই না তুচ্ছ!

অবাক ভাবনায় কেটে গেল সময়। এবার কায়রোর আলআযহারে ফেরার পালা। বিদায় আজিবা! সময় পেলে আবার আসব তোমার নীল সমুদ্রতীরে। মহান আল্লাহর সৃষ্টি জগতের অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে।

পূর্ববর্তি সংবাদগ্রিসে শরণার্থীদের বিবস্ত্র করে নির্যাতন
পরবর্তি সংবাদমনোনয়ন সংগ্রহে শো-ডাউন বন্ধের নির্দেশ