মিশনারিদের শিক্ষা-ফাঁদ: কোন দিকে যাচ্ছে কোমলমতিরা?

আতাউর রহমান খসরু ।।

‘বাংলাদেশে খ্রিস্টান মিশনারিগুলো পাঁচ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে’ দুদিন আগে এরকম একটি সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। সাদা চোখে সংবাদটি বিশেষ কোনো তাৎপর্য বহন করে না। তবে যারা ভারতবর্ষে ইংরেজ সম্রাজ্যের বিস্তার এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে পূ্র্ব তিমুরের স্বাধীন হয়ে যাওয়ার ইতিহাস জানেন তাদের আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

কারণ, ভারতবর্ষে খ্রিস্টানদের আগমন হয়েছিলো বাইবেল হাতে। যা এক সময় রাজদণ্ডে পরিণত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইন্দোনেশিয়ার প্রদেশ পূর্ব তিমুরে খ্রিস্টান মিশনগুলো যাত্রা শুরু করেছিল শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে। তারা সেখানে স্কুল ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে।ধীরে ধীরে মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব তিমুর খ্রিস্টান জনপদে পরিণত হয়।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্টান মিশনারিগুলোর তৎপরতা নিয়ে তাই প্রশ্ন উঠেছে দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যমে। অনেকের মতে সেখানের রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনে গির্জাগুলোর ভূমিকাও রহস্যময়। তাই শুধু ধর্মীয় বিবেচনায় নয়, রাজনৈতিক বিবেচনায়ও এ সংবাদটি আঁতকে ওঠার মতো।

কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. হাফেজ এবিএম হিজবুল্লাহও এই দুই আশঙ্কার কথা তুলে ধরলেন। তিনি বলেন, ‘জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অবশ্যই এটি আশঙ্কাজনক। একদিকে তারা শিশুদের ধর্মহীন করে তুলছে, অন্যদিকে তারা তাদের জনসংখ্যা ‍বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাচ্ছে। পূর্ব তিমুর তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।’

‘আপনি দেখবেন, তাদের কার্যক্রম সাধারণত এমন জায়গায় হয় যেখানে প্রশাসন ও অন্যান্য মানুষের যাতায়াত খুব কম। যেন খুব সহজে তাদের কাজ চোখে না পড়ে। তারা কেন্দ্র থেকে ছড়ায় না; বরং ছড়াতে ছড়াতে কেন্দ্রকে বেষ্টন করে ফেলে।’- যোগ করেন তিনি।

একই রকম আশঙ্কার কথা বলেন ইসলামি দাওয়াহ ইনস্টিটিউটের পরিচালক মুফতি যোবায়ের আহমদ। তিনি বলেন, ‘ভয়ের কারণ অনেক। তারা খ্রিস্ট ধর্ম শেখায়, খ্রিস্ট ধর্মে উৎসাহিত করে। সব শেখায় ইসলাম শেখায় না। আমি মনে করি, তারা তাদের মতবাদ প্রচারের জন্য শিক্ষা-মাধ্যমকে বেছে নিয়েছে, কারণ শিক্ষা একটি নীরব আন্দোলন। যে কোনো মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষা সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম।

অধ্যাপক হিজবুল্লাহর কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পাঁচশ মিশনারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চারশই প্রাইমারি স্তরের- অর্থাৎ তারা প্রাথমিক স্তরকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। সেটা কেন? উত্তরে তিনি বলেন, একটা শিশু যদি শৈশবে ধর্মহীন থেকে যায় তবে প্রাপ্ত বয়সে তাকে দীনমুখী করা সহজ নয়। আমি উত্তরবঙ্গের অনেক জায়গায় শুনেছি, মিশনারি স্কুলে সরাসরি খ্রিস্ট ধর্ম বিশ্বাস, যিশু খ্রিস্ট সম্পর্কে পড়ানো হয়। এর ফলে ওইসব স্কুলের শিশুরা ইসলাম সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ছে।

এর কিছু দৃষ্টান্তও তুলে ধরলেন মুফতি যোবায়ের আহমদ। অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, ‘ঠাকুরগায়ের পুরিহিয়ায় গিয়েছিলাম। সেখানে এক খ্রিস্টান স্কুল পরিদর্শন করি। প্রিন্সিপালকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কাদের নামে খাবার খাওয়ান? তিনি উত্তর দিলেন, আমরা প্রভুর নামে খাবার খাওয়াই। একটা শিশুকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কার নামে খাবার খাও? বললো, আমরা যিশুর নামে খাবার খাই।’

বাংলাদেশে মিশনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু কৌশলও বর্ণনা করেন ড. হিজবুল্লাহ। তাহলো, ‘তারা দেশীয় আইন ও কারিকুলাম অনুসরণ করে। তবে নিজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে। প্রথমেই খোলাখুলি কিছু করে না। তারা জানে তা করতে গেলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। বিরূপ প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে চলতে তারা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে। ভেতরের অবস্থা জানি না, জানার সুযোগও থাকে না।’

দেশীয় আইন ও শিক্ষা কারিকুলাম অনুসরণ করার পরও ভয়ের কোনো কারণ আছে? তিনি মনে করেন আছে। কারণ, ‘বাহ্যত দেখে ভয়ের কিছু আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু ভয় আছে। সেটা এভাবে যে, তাদের পরিকল্পনা সুদূর প্রসারী।’ বলেন এবিএম হিজবুল্লাহ।

তিনি আরও বলেন, ‘সবাইকে টার্গেট করা হয় এমন না। তাদের টার্গেট থাকে তারাই যাদের তারা বোঝাতে পারবে, যারা তাদের ফাঁদে পড়বে। যেসব শিক্ষার্থীদের তাদের লক্ষ্যে পরিণত হয় ক্রমন্বয়ে তাদের ধর্মহীন করে তোলে। তাদের বাৎসরিক টার্গেট থাকে, দশক ভিত্তিক টার্গেট থাকে। যখন তা পূর্ণ হয় তখন তারা মনে করে আমরা সফল। আর পুরো বিষয়টা করে চাতুর্য-এর সাথে।’

মুফতি যোবায়ের আহমদের বক্তব্যে বিষয়টি একইভাবে উঠে আসে। তিনিও বলেন, ‘সরাসরি ধর্মান্তর করে না। তবে শিশুদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে এমনভাবে দুর্বল করে দেয় যে পরবর্তীতে ধর্মান্তর করা সহজ হয়। খ্রিস্ট বিশ্বাসের গ্রহণযোগ্যতা তাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। ধরেন, কেউ যদি মনে করে খ্রিস্টান ধর্ম ইসলামের মতো গ্রহণযোগ্য একটি ধর্ম। তাহলে বিশ্বাসের জায়গায় কোথায় যাচ্ছে তারা?’

বাংলাদেশে খ্রিস্টান মিশনারি পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামডাক বেশ। দেশের উচ্চশ্রেণির মধ্যে মিশনারি স্কুলে সন্তানকে পড়ানোর একটি নীরব প্রতিযোগিতা রয়েছে। এ বিষয়টি উপস্থাপন করলে প্রফেসর হিজবুল্লাহ বিষয়টির ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘তাদের সবচেয়ে বড় কৌশল তারা শিক্ষার মান বজায় রাখে। সমমানের প্রতিষ্ঠানের চেয়ে শিক্ষার মান ভালো করার চেষ্টা করে। আপনি দেখবেন, ওদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুসলিম পিতা-মাতা সন্তানদের ভর্তি করানোর জন্য জানপ্রাণ চেষ্টা করে। ওরা জানে পণ্য ভালো না হলে বাজারে চাহিদা তৈরি হয় না।’

মুফতি যোবায়ের খ্রিস্টানদের আরেকটি কৌশল তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মিশনারি স্কুলগুলো এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় মুসলিম পরিভাষাগুলো ব্যবহার করে শিশুদের বিভ্রান্ত করে। মুফতি যোবায়ের আহমদ তার অন্য আরেকটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘আমি পার্বতীপুর গিয়েছিলাম। সেখানে অনেক মুসলমান খ্রিস্টান হয়ে গেছে। সেখানে একটি শিশুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কোথায় পড়? বললো, হাসপাতালের স্কুলে। আমি জানতে চাইলাম সে কী পড়ে? সে জানালো, বাংলা, ইংরেজি ও অংকের সাথে মুসলিম বাইবেল পড়ে। মুসলিম বাইবেলে কি পড়? সে বললো, ইসলামি গান। গান শোনাতে বললে সে শোনালো,

যিশু আমার সঙ্গে,
আমিও তার সঙ্গে,
তিনি আমাকে প্রেম করেন,
তিনি আমাকে রক্ষা করেন।

এটা আমার নিজের কানে শোনা ও দেখা। তারা শেখাচ্ছে খ্রিস্টীয় ধর্ম বিশ্বাস, কিন্তু নাম দিচ্ছে ‘মুসলিম বাইবেল’ আর ‘ইসলামি গান’।

বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং সম্পূর্ণ অবৈতনিক হওয়ার পরও মিশনারি স্কুলের প্রতি মানুষ ঝুঁকছে কেন? উত্তরে ড. এবিএম হিজবুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের দেশে শিক্ষা এখনও সহজলভ্য না হওয়ায় এখনও বিপুল সংখ্যক শিশু শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে থেকে যায়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠির এসব শিশুদের এরা সব শিক্ষা উপকরণ বিনামূল্যে দেয়। মনস্তাত্ত্বিকভাবেই তখন পরিবারগুলো তাদের প্রতি ঝুঁকে যায়। ভাবে, এরা কতো কিছু দেয়, কিছুই নেয় না।’

আরও পড়ুন : বাংলাদেশে ৫ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে খ্রিস্টান মিশনারিগুলো

তিনি মনে করেন, ধর্মান্তর খ্রিস্টানদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলেও এখন তাদের লক্ষ্য ধর্মহীন করে তোলা। এ ব্যাপারে ড. হিজবুল্লাহ বলেন, ‘১৯৩৫ সালে এক সেমিনারে একজন যাজক বলেছিলেন, আমাদের উদ্দেশ্য মুসলমানদের ধর্মান্তর করা নয়; বরং ধর্মহীন করে দেয়া উদ্দেশ্য। তারা নামে মুসলিম থাকবে কিন্তু ইসলামের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ থাকবে না। এতোটুকু হলেই আমাদের লক্ষ্য পূরণ সম্ভব। এটাই কিন্তু হচ্ছে।’

এ সংকট মোকাবেলায় একই রকম সমাধান তুলে ধরেন ড. হিজবুল্লাহ ও মুফতি যোবায়ের। তারা বলেন, এর মোকাবেলা করতে হলে বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। শুধু মক্তব নয়, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করা লাগবে আমাদের।

ড. হাফেজ এবিএম হিজবুল্লাহ বলেন, ‘তাদের বিপরীতে শিক্ষাব্যবস্থা সহজ এবং মিশনারি ওয়ার্ক করতে হবে। আমরা দেখেছি, যদি কোনো মিশনারি স্কুলের পাশে কোনো দ্বীনি প্রতিষ্ঠান থাকে এবং সেখানে সুযোগ সুবিধা কম থাকলেও সেখানে সন্তানদের পড়াতে আগ্রহী হয় বাবা-মা। এটা তাদের মাথাব্যাথার কারণ হয়।’

‘শুধু মাদরাসা বা মক্তবে সব শিশুকে পড়ানোর জন্য প্রস্তুত থাকবে না অনেক পিতা-মাতা। আক্রান্ত এলাকায় ইসলাম মিশনারি স্কুল খোলা প্রয়োজন মনে করছি আমরা। সরকারি কারিকুলাম সামনে রেখে প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত আমাদের খুলতে হবে। শুধু মাদরাসা বা মক্তব করে তাদের সমান্তরাল মোকাবেলা করা যাবে না।’ বলেন তিনি।

মুফতি যোবায়ের আহমদও ফ্রি স্কুল খোলার পরামর্শ দেন। সেটা ইসলামি নামে না হলেও যেন সেখানে ইসলাম শেখানো হয়। সাথে সাথে তিনি খ্রিস্টান মিশনারির মতো অমুসলিমদের মধ্যে দ্বীনি দাওয়াত পৌঁছে দেয়ারও আহবান জানান।

পূর্ববর্তি সংবাদবিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় কিশোরীকে হত্যা
পরবর্তি সংবাদনবীগণের সিরাত আলোচনা করব হেদায়েত গ্রহণের জন্য, দোষ খোঁজার জন্য নয়