‘হাদিস, তাফসির ও ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়াদি অক্ষুন্ন রেখে সিলেবাস ঢেলে সাজানো অতীব প্রয়োজন’—মুহাম্মদ ফুরকানুল্লাহ খলীল

জামেয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়া চট্টগ্রাম-এর নায়েবে মুদীর, সিনিয়র মুহাদ্দিস, মাসিক আল হক-এর সম্পাদক, গবেষক আলেমেদ্বীন মুহাম্মদ ফুরকানুল্লাহ খলীল। সম্প্রতি কওমি মাদরাসার সিলেবাস, স্বীকৃতি এবং স্বীকৃতিকেন্দ্রিক বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ইসলাম টাইমস-এর পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন মাহমুদ মুজীব


 

ইসলাম টাইমস : সময় ও পরিবেশের প্রেক্ষাপটে কওমি মাদরাসা শিক্ষার সিলেবাস সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা কতটা প্রয়োজনীয় মনে করেন?

মুহাম্মদ ফুরকানুল্লাহ খলীল : হ্যাঁ, দারুল উলুম দেওবন্দের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হাদিস, তাফসির ও ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়াদি অক্ষুন্ন রেখে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সিলেবাস ঢেলে সাজানো অতীব প্রয়োজন। যাতে শিক্ষার্থীরা ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানে দক্ষতা, আরবি ও বাংলা ভাষা-সাহিত্যে পারঙ্গমতা অর্জন এবং আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উৎকর্ষ সাধন করে ইসলামের প্রকৃত প্রচারক এবং দেশ ও জাতির একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে আত্মনিয়োগ করতে পারে।

ইসলাম টাইমস : আপনি কি মনে করেন, বর্তমানে কওমি মাদরাসাগুলো যে সিলেবাসে পড়ানো হয় সে সিলেবাসে পড়ে তারা তারা রাষ্ট্রের কোনো কাজে আসতে পারবে?

মুহাম্মদ ফুরকানুল্লাহ খলীল : রাষ্ট্রের কাজে আসা-না আসা সিলেবাস পড়া-না পড়ার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখে বলে মনে করি না। কওমি বলুন, আলিয়া বা জেনারেল শিক্ষার সিলেবাস বলুন, যেকোনো সিলেবাসে পড়ুয়ারা তখনই রাষ্ট্রীয় কাজে আসতে পারে যখন যথাযথ যোগ্যতা অর্জিত হয়। আর এর জন্যে সিলেবাসের বাইরেও পড়ালেখার প্রয়োজন আছে।

ইসলাম টাইমস : আধুনিক শিক্ষার মতো বর্তমানে কওমি মাদরাসার সনদপ্রাপ্ত অনেক আলেমকেও বেকার থাকতে দেখা যায়। এটার কারণ কী?

মুহাম্মদ ফুরকানুল্লাহ খলীল : বেকারত্ব একটি জাতীয় সমস্যা। অশিক্ষিতদের তুলনায় শিক্ষিতরাই অধিকহারে বেকার। এর জন্যে অহমিকা, আত্মপ্রবঞ্চনা, অলসতা ও অসচেতনতাই দায়ী। জীবন-জীবিকার তাগিদে যেকোনো কাজ করতে পারলে বেকার থাকার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু কোনো দাওরা পাশ বা কামিল পাশ আলেম বা মাস্টার্স-করা কোনো জেনারেল শিক্ষিত যুবক কি আমাদের সমাজে নিম্নমানের কাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রিক্সা চালানো, ঠেলাগাড়ি চালানো-সহ নানা ধরনের শ্রমব্যয়ে বৈধ উপার্জনে রাজি হবে? অথচ উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ শ্রমজীবী উচ্চশিক্ষিত। সকল শিক্ষিত মানুষের কর্মসংস্থান করা কোনো সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। নিজের কর্ম নিজেকেই সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষত দেওবন্দী ধারার কওমি আলেমরা শিক্ষাকে জীবন-জীবিকার উপলক্ষ বানাতে পারেন না। অন্য যে কোনো হালাল উপায়ে উপার্জন করে সংসার চালাতে হবে। এটিই আকাবিরদের আদর্শ ও নৈতিক দীক্ষা।

ইসলাম টাইমস : সম্প্রতি কওমি শিক্ষাসনদের স্বীকৃতি আইনের গেজেট হওয়ার মাধ্যমে সকল আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

মুহাম্মদ ফুরকানুল্লাহ খলীল : এতোদিন কওমি আলেমেরা অশিক্ষিত গণ্য হয়ে আসছিলেন। এখন থেকে তারা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে মাস্টার্সধারী উচ্চশিক্ষিত হিসেবে গণ্য হবেন। ব্যক্তি, সরকার ও যেকোনো প্রতিষ্ঠান তাদের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী হিসেবে কাজে লাগাতে পারবে।

ইসলাম টাইমস : কওমি মাদরাসার যেসব ছাত্র আলিয়ামুখী ছিলো, স্বীকৃতির কারণে কি এ প্রবণতা কমবে বলে মনে করেন?

মুহাম্মদ ফুরকানুল্লাহ খলীল : না, মনে করি না। কারণ বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী দাওরা পর্যন্ত পৌঁছার সুযোগ পায় না। তাদের অনেকে সমাজে একাডেমিক স্বীকৃতির লক্ষ্যে বিভিন্ন স্তরের সরকারি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে থাকে।

ইসলাম টাইমস : সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিতে কোনো শংকা দেখছেন?

মুহাম্মদ ফুরকানুল্লাহ খলীল : কওমি মাদরাসায় সিলেবাসভুক্ত কিতাবগুলো আদ্যোপান্ত পড়ানো ও সিলেবাস শেষ করার ঐতিহ্য রয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠে। স্বীকৃতির ফলে ভালো পাশ করা ও পাশ করানোর জন্যে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকমণ্ডলী গাইড ও সাজেশনের আশ্রয়ে পরীক্ষানির্ভর হয়ে পড়তে পারে। ফলে বার্ষিক পাঠ্যসূচি শেষ না করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আল্লাহ না করুন, এমনটি হলে কওমি ঐতিহ্য ক্ষুণ্ন হওয়া ও যোগ্য আলেম সৃষ্টি না হওয়ার আশংকা রয়েছে।

ইসলাম টাইমস : স্বীকৃতির সুফল পেতে কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড হাইয়াতুল উলয়ার কোন্ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত?

মুহাম্মদ ফুরকানুল্লাহ খলীল : ঐকমত্যের ভিত্তিতে; যেমন আন্দোলনের মাধ্যমে স্বীকৃতি আদায়ে সফল হয়েছে তেমনি তা সার্থক করে তোলার জন্যে প্রশাসনিক ও একাডেমিক ক্ষেত্রে ঐকমত্য ও সমন্বয়ের প্রয়োজন। বিভিন্ন বোর্ডের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি এক ও অভিন্ন হওয়া দরকার। নিচের স্তরগুলোকে স্বীকৃতির আওতায় আনার জন্যে সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রয়াস চালানো অপরিহার্য। যাতে পুরো কওমি শিক্ষা কারিকুলাম জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়।

ইসলাম টাইমস : স্বীকৃতিতে যারা অবদান রেখেছেন তাদের সংবর্ধনা দেয়াটা কোন দৃষ্টিতে দেখেন?

মুহাম্মদ ফুরকানুল্লাহ খলীল : শিক্ষার স্বীকৃতি প্রত্যেক নাগরিকের মানবিক অধিকার। কওমি ঘরানার আলেম-উলামা এতোদিন এই অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। যারা এ অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছেন তারা অবশ্যই ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবেন। তবে বর্তমানে সংবর্ধনা একটা রাজনৈতিক রেওয়াজে পরিণত হয়ে হয়েছে। যা কওমি মাদরাসার ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্যবিরোধী। সুতরাং আড়ম্বরপূর্ণ রেওয়াজি সংবর্ধনা পরিহার করে মহান আল্লাহর দরবারে তাদের সার্বিক কল্যাণের জন্যে দোয়া করাই শ্রেয় মনে করছি।

ইসলাম টাইমস : ইসলাম টাইমসকে সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

মুহাম্মদ ফুরকানুল্লাহ খলীল : আপনাকেও ধন্যবাদ।

পূর্ববর্তি সংবাদবিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর এখন তুরস্কে
পরবর্তি সংবাদময়মনসিংহে বন্দুকযুদ্ধে দুজন নিহত