পাকিস্তানে ভারতীয় টিভি চ্যানেল নিষিদ্ধ : কী বার্তা নিতে পারে বাংলাদেশ?

আতাউর রহমান খসরু  ।।  

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব দিন দিন প্রকট আকারে দৃশ্যমান হচ্ছে। বাংলাদেশের ভাষা-সাহিত্য থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা – সবকিছুই আচ্ছন্ন করে ফেলছে ভারতীয় সংস্কৃতি। একদিকে তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশ হিন্দি ভাষায় কথা বলতে পেরে তৃপ্ত হচ্ছে, অন্যদিকে বাঙালি ললনার সাজ-সজ্জায় জায়গা করে নিচ্ছে ভারতীয় পোশাক-পরিচ্ছদ। চিন্তা-চেতনায় আসছে আতংজনক পরিবর্তন। ভারতীয় সমাজের নগ্নতা, পরকীয়া, বহুগামিতা, সাংসারিক কলহ ও বস্তুবাদী স্বার্থান্ধতাও পেখম মেলছে বাংলাদেশের সমাজ ও পরিবারের ভাঁজে ভাঁজে।

ভারতীয় সংস্কৃতির প্রধান বাহন ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো। বাংলাদেশের পারিবারিক কলহের পেছনে বার বার উঠে আসছে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের নাটক, সিনেমা ও সিরিয়ালগুলোর নাম। এমনকি ভারতীয় সিরিয়াল থেকে খুন-হত্যার কৌশল রপ্ত করার অভিযোগও পাওয়া গেছে আসামীর জবানবন্দিতে।

দীর্ঘদিন যাবত দেশের সচেতন বুদ্ধিজীবীরা ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো বন্ধের দাবি জানিয়ে আসলেও এ ব্যাপারে সরকারের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট এক আদেশে সে দেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো বন্ধের নির্দেশ জারি করেছেন। এর পেছনে ভারত কর্তৃক অভিন্ন নদীর পানি বন্ধকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন সে দেশের আদালত।

পানি বন্ধকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করলেও এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে বলে মনে করেন কবি ও গীতিকার মুহিব খান। তিনি বলেন, ‘ভারত তার আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করতে চাচ্ছে। মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে টিভি চ্যানেলগুলোকে। পাকিস্তান ভারতের সাংস্কৃতিক প্রভাব রোধ ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বিষয়কে সামনে রেখেই হয়তো ভারতীয় চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ করতে পারে।’

মুহিব খান

তবে মুহিব খান মনে করেন, শুধু ভারতীয় চ্যানেল নয়; বরং যে কোনো দেশের যে কোনো ক্ষতিকর চ্যানেল বন্ধ হওয়া দরকার। চ্যানেল বন্ধের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনার চেয়ে সাংস্কৃতিক বিষয়গুলিই সামনে রাখা দরকার।

বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শাহ ইফতিখার তারিক অবশ্য একটু ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি মনে করেন ভারতীয় চ্যানেলগুলোর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কোনো প্রভাবই অস্বীকার করার মতো নয়। তাই যে কোনো বিচারে চ্যানেলগুলো বন্ধ হতে পারে।

তিনি বলেন, ‘ইন্ডিয়ান চ্যানেলগুলো আমাদের জীবন ধ্বংস করছে। শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ধ্বংস করাই তো জীবন ধ্বংস করা। চ্যানেলগুলো আগামী প্রজন্মকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। তারা হিন্দিতে কথা বলছে আর ভিন্ন সংস্কৃতি বুকে ধারণ করে বড় হচ্ছে। ভারতীয় সিরিয়ালগুলোর প্রভাবে পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে। ভারতীয় পণ্যতে আমাদের বাজার ছেয়ে যাচ্ছে। তাদের সাথে আমাদের বাণিজ্যিক বৈষম্য বাড়ছেই। একটি জাতিকে গোলামে পরিণত করার সব কাজই করছে তারা। আর তাতে সহযোগী হচ্ছে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো।’

শাহ ইফতিখার তারিক আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় দেখুন! ভারতের কোনো কোনো নেতা এবং আমাদের দেশের কথিত কয়েকজন বুদ্ধিজীবী সীমানা উঠিয়ে দেয়ার কথা পর্যন্ত বলছে। কিন্তু জনগণের ভেতর তার প্রতিক্রিয়া নেই। কেন? কারণ, চিন্তা-চেতনায় তারা ভারতীয়দের দ্বারা এতো প্রভাবিত যে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের উপর এ হুমকির গুরুত্ব তারা বুঝতে পারছে না। তাই যে কোনো বিবেচনায় চ্যানেলগুলো বন্ধ হওয়ার দাবি রাখে।’

শাহ ইফতিখার তারিক ও কবি মুহিব খান উভয়ে মনে করেন, পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো বন্ধের যে নির্দেশনা জারি করেছে তাকে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনার প্রয়োজন নেই। কারণ, এতে ভারতপ্রীত লোকেরা ‘পাকিস্তান’ বলে গা বাঁচানোর সুযোগ পাবে। দ্বিতীয়ত আমাদের দেশই যেখানে আক্রান্ত সেখানে পাকিস্তানকে দৃষ্টান্ত বানানোর প্রয়োজনীয়তা কোথায়? বিশেষত যখন ভারতে বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো সম্প্রচারের অনুমতি নেই, তখন আর কোনো যুক্তির প্রয়োজন হয় না। অন্তত এ বৈষম্য ও লজ্জা রোধ করার জন্যই তো ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো বন্ধ হতে পারে।

শাহ ইফতেখার তারিক

‘টিভি চ্যানেলগুলো বন্ধ হলেই কি ভারতীয় সংস্কৃতির ঢল থামানো যাবে?’ শাহ ইফতিখার তারিকের মতে, তার পুরোটা সম্ভব না হলেও অনেকটাই সম্ভব হবে। টিভি চ্যানেলগুলো হলো দরজার মতো। দরজা বন্ধ হয়ে গেলে বিকল্প পথে খুব সামান্য অংশই ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।

জনস্বার্থে বাংলাদেশের আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে অনেক নির্দেশনা জারি করেন। ভারতীয় টিভি চ্যানেল বন্ধে এমন সাংস্কৃতিক নির্দেশনা জারি হতে পারে বলে মনে করেন ইসলামী ধারার এই দুই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

বাংলাদেশের প্রশাসন যদি ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধের উদ্যোগ না নেয় তবে তার ভবিষ্যত প্রতিক্রিয়া কী হবে?

এমন প্রশ্নের উত্তরে দুজন-ই দেশ ও দেশের সংস্কৃতি; বিশেষত ভবিষ্যত প্রজন্মের ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

শাহ ইফতিখার তারিক বলেন, ‘এখনই প্রতিটি সেক্টরে বাংলাদেশি পণ্য ভারতীয় পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতা করছে। কৃষিপণ্য থেকে শুরু করে ভারী শিল্প – সবকিছুতেই প্রতিযোগিতা হচ্ছে এবং ভারতীয় পণ্যই এগিয়ে যাচ্ছে বা এগিয়ে দেয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ প্রতিযোগিতা বা চাপ আরও বাড়বে; বরং দেশের শিল্প-বাণিজ্য ভারতের কব্জায় চলে যাবে।’

কবি মুহিব খান বলেন, ‘এমন একটি প্রজন্ম তৈরি হবে যারা দেশের চেয়ে ভারত ও ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি, রীতি-নীতি ও আদর্শকে ভালোবাসবে। তখন ভারতকে এদেশের মাটিতে এসে শাসন করতে হবে না; বরং ভারত না চাইতেই সবকিছু তার ইচ্ছেমাফিক পরিচালিত হবে।’

কবি মুহিব খানের এ আশঙ্কা কি একদমই অমূলক? না কি এর পেছনে বাস্তবতা রয়েছে, সেটা সময়ই বলে দেবে।

পূর্ববর্তি সংবাদশ্রীলঙ্কায় সহিংসতায় একজন নিহত
পরবর্তি সংবাদদুর্নীতি মামলায় খালেদার ৭ বছরের কারাদন্ড