বিশ্বাসের ফুলকি

শামীম আহমাদ  ।।  

বিশ্বাসের ফুলকি-১

بَلْ كَذَّبُوا بِمَا لَمْ يُحِيطُوا بِعِلْمِهِ وَلَمَّا يَأْتِهِمْ تَأْوِيلُهُ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ

‘আসল কথা হচ্ছে, তারা মিথ্যা সাব্যস্ত করছে সেই বিষয়কে যার জ্ঞান তারা আয়ত্ত করতে পারেনি, এবং এখনও তার পরিণাম তাদের সামনে আসেনি। তাদের পূর্বে যারা ছিল তারাও এভাবেই অস্বীকার করেছিল।’ [সুরা ইউনুস: ৩৯]

 

বিশ্বাসের ফুলকি-২

উইন উড রিড [Win wood Reade] লিখেছেন-

‘এটা আমাদের একটি আবশ্যিক ভাবনার বিষয়- ঈশ্বরের সাথে আমাদের কি কোনো সম্পৃক্ততা সত্যই আছে? এই দুনিয়া ছাড়াও কি রয়েছে মৃত্যুর পর আরেক দুনিয়া? যেখানে আমাদের কর্ম অনুপাতে ফল দেওয়া হবে। এটি শুধু দর্শনেরই এক প্রধানতম সমস্যা নয়; বরং আমাদের বাস্তব জীবন নিয়ে কার্যকর এক প্রশ্ন, যার সাথে জুড়ে আছে আমাদের অনেক কল্যাণ ও সম্ভাবনা। বিপর্যয় ও আশঙ্কা।

কারণ, আমাদের বর্তমান জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত এবং এর সুখ-আনন্দও অতি সীমিত। অনেক শ্রম-প্রচেষ্টার পর যখন আমাদের কামনাগুলো চরিতার্থ করার সময় ও সুযোগ আসে, তখনই হানা দেয় জরা-মৃত্যুর অক্ষমতা। এখন এটা যদি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, কোনো এক বিশেষ পদ্ধতিতে জীবন যাপন করলে চিরন্তন সুখ ও আনন্দ অর্জিত হয়, তবে তো নির্বোধ আর পাগল ছাড়া কেউই সে ধরনের জীবন যাপন করতে অস্বীকার করবে না।’

 

বিশ্বাসের ফুলকি-৩

লিও টলস্টয়। সাংসারিক সাফল্যের চূড়ায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি উপলব্ধি করেন যে, মানব জীবনের অন্বিষ্ট বা কাঙিক্ষত লক্ষ্য যশ নয়, বিভব নয়, মানসম্মান নয়, রাজক্ষমতা নয়, ভোগবিলাস নয়। মৃত্যু অপেক্ষা করছে তার আত্মাকে এক অজানা লোকে নিয়ে যেতে… সেখানে সে একা এবং নিঃসম্বল।

 

বিশ্বাসের ফুলকি-৪

বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে একবার জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন? উত্তরে আইনস্টাইন বলেন, ‘আমি নিরশ্বরবাদী নই, তবে সমস্যাটা এতই জটিল যে আমাদের সীমিত বুদ্ধিতে তা কুলায় না।’ [মোহাম্মদ হান্নান, অন্যদিন- ৫৯]

 

বিশ্বাসের ফুলকি-৫

লেখক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘কিছু শৈশব’ বইয়ের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘যেই রহস্যময় জগতে আমরা বাস করি তার অনেক কিছুই আমরা জানি। আবার অনেক কিছুই জানি না। না জানার পাল্লাটাই মনে হয় ভারী। ‘বলপয়েন্ট’ গ্রন্থের ৯৭ পৃষ্ঠায় বলেন, ‘আমি আমার এক জীবনে (ষাট বছরে) অনেক ব্যাখ্যার অতীত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি।’

 

বিশ্বাসের ফুলকি-৬

বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন তাঁর অধ্যয়নকক্ষে পড়াশোনা করছেন। তাঁর সমুখের টেবিলের ওপর আমাদের সৌরমণ্ডলের একটি ক্ষুদ্রাকার নিখুঁত মডেল। একজন দক্ষ কারিগর কিছুদিন আগে এটি তৈরি করে দিয়েছেন। সৌরজগতের আদলে মডেলটিতে এমন সব গোলক স্থাপন করা হয়েছে, যা মোড় ঘোরার সময় সঞ্চালিত হয়। এমনভাবে খাঁজ বা দাঁত ও বেল্ট সংযোজন করা হয়েছে, যার কারণে এর সকল গ্রহ-উপগ্রহ বাস্তব সৌরজগতের মতোই নিজেদের কক্ষপথে ঘুরতে পারে।

নিউটন যখন গভীর অধ্যয়নে মগ্ন, এ সময় তাঁর এক নাস্তিক বন্ধু তাঁর সাথে দেখা করতে আসে। রুমের মধ্যে প্রবেশ করতেই বন্ধুটির চোখ পড়ে সৌরমডেলটির উপর। বন্ধুটি নিজেও একজন বিজ্ঞানী। টেবিলের উপর রাখা মডেলটি দেখেই বুঝে গেলেন এটা কী। তিনি খুবই আশ্চর্য ও বিস্মিত হলেন। মানুষের হাতে গড়া এত  সুন্দর একটি সৌরমডেল!

মডেলটির কাছে এসে ধীরভাবে তার খাঁজগুলো ঘুরিয়ে দিলেন। বাস্তব সৌরজগতের মতোই মডেলটি তার সকল গ্রহ-উপগ্রহসমেত ঘুরতে লাগল। আকাশমার্গীয় অবয়বগুলো তাদের নির্দিষ্ট কক্ষপথে আপেক্ষিক গতিবেগে চলতে শুরু করল। বিজ্ঞানী বন্ধু বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে বলে উঠলেন-

My! What an exquisite thing this is! Who made it?  আরে! এটা কী নিঁখুত সুন্দর জিনিস। কে তৈরি করল এটা?

নিউটন তাঁর বইয়ের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই অবিচলিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, Nobody – কেউ না। এটি কেউ তৈরি করেনি।

একথা শোনামাত্রই নিউটনের দিকে মুখ করে নাস্তিক বন্ধু বলে উঠলেন, স্পষ্টতই মনে হচ্ছে, তুমি আমার প্রশ্নটি বুঝতে পারনি। আমি জিজ্ঞেস করেছি, এই জিনিসটি তৈরি করেছে কে?

এবার নিউটন বই থেকে তার চোখ তুলে শান্তস্বরে বললেন, ‘আমি তোমার প্রশ্ন খুব ভালোভাবেই বুঝেছি। সেকারণেই বলছি- ‘না, এটাকে কেউ তৈরিই করেনি। তবে মহাজগতের বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তুর সংযোজন এতই বিস্ময়কর যে, এটি আপনা-আপনিই তৈরি হয়ে গেছে। কারও তৈরি করতে হয়নি…’

একথা শুনে বিস্মিত নাস্তিক বন্ধু তীব্র ভাষায় বলে উঠলেন, ‘তুমি কি আমাকে বোকা পেয়েছ! অবশ্যই এটা কেউ না কেউ তৈরি করেছে। সন্দেহ নেই, যে এটি তৈরি করেছে, সে একটি মস্ত বড় প্রতিভা। তাই তো আমি জানতে চাই, লোকটি কে? কে এত নিঁখুতভাবে তৈরি করল এটি?’

নিউটন এবার তাঁর বইটি একপাশে রেখে উঠে দাঁড়ালেন এবং বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘বন্ধু, একটি বড় পদ্ধতির এটি একটি ক্ষুদ্র অনুকরণ, যার নিয়ম তুমি জানো। আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না যে, এই অতি ক্ষুদ্র মডেলটি কোনো পরিকল্পনাকারী ও নির্মাতা ছাড়াই অস্তিত্বে এসেছে। এবং তুমি সেটি বিশ্বাসও করবে না। অথচ এই ক্ষুদ্র মডেলটিতে যেই বাস্তব বড় মৌল আকৃতির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, তার ক্ষেত্রে তুমি কিভাবে এই সিদ্ধান্ত দাও যে তা কোনো পরিকল্পনা নির্মাতা ছাড়াই অস্তিত্বমান হয়েছে?’

বন্ধুটি হতভম্বের মতো নিউটনের দিয়ে চেয়ে রইলেন। মুখে কোনো কথা নেই। [ Minnesota Technology, October 1957 ]

 

বিশ্বাসের ফুলকি-৭

কবি শহীদ কাদরী হুমায়ূন আহমেদকে ফোন করে বলেন, হুমায়ূন আমি নাস্তিক মানুষ। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে প্রার্থনায় বিশ্বাস করা শুরু করেছি। আপনি নিশ্চয় জানেন, আমেরিকার সব হাসপাতালে রোগীদের জন্য প্রার্থনার  ব্যবস্থা আছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যাদের জন্য প্রার্থনা করা হয়, তারা দ্রুত আরোগ্য লাভ করে।

আমি আমার স্ত্রীকে আপনার জন্য প্রার্থনা করতে বলেছি।  [শহীদ কাদরী, ব্ল্যাক ফ্রাইডে ২০১১, জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক। [নিউয়য়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ]

পূর্ববর্তি সংবাদজর্ডানে বন্যায় নিহত ২০
পরবর্তি সংবাদ‘ইয়াবা যুগে’ বাংলাদেশ, মাদকের বিস্তার ঘটছেই