রাশিয়ার ধ্বংসের বড়াই!

ওয়ারিস রব্বানী ।।

রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর নাম সেরগেই শইগু। এই ভদ্রলোকের একটি বক্তব্য গত ২১ অক্টোবরের গণমাধ্যমে ঠাঁই পেয়েছে। বক্তব্যটি দেওয়া হয়েছে ২০ অক্টোবর শনিবার সিঙ্গাপুরে । সেই বক্তব্যে বলা হয়েছে সিরিয়ার যুদ্ধে রাশিয়া ৮৭ হাজার পাঁচশরও বেশি সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে।

আসিয়ান দেশগুলোর প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের সম্মেলন ছিল সেটি। রাশিয়ান মন্ত্রীর বক্তব্যটি সেই সম্মেলনেরই। ওই বক্তব্যে তার আরও কথা ছিল। ২০১৫ সালে সিরিয়াযুদ্ধে যুক্ত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত রাশিয়া সেখানে ৪০ হাজারেরও বেশি বোম্বিং মিশন পরিচালনা করেছে। এতে ১৪১১টি সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস হয়েছে। ১ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি অবস্থানকে টার্গেট করা হয়েছে। সন্ত্রাসীদের সব স্থাপনা ও অস্ত্রাগার ধ্বংস করা হয়েছে।

উপরে যা উল্লেখ করা হলো, এগুলো সবই গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ওই বক্তব্যের সূত্র ধরেই এসব তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে। গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার মতো করে এসব তথ্য সামনে আসেনি। উইকিলিকস জাতীয় কোনো ঘটনা এক্ষেত্রে ঘটেনি। প্রকাশ্য দম্ভ ও বর্বরতার বীরত্বসূচকতা তুলে ধরেই এ তথ্যগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে।

Image result for attack in syria

একটু ভাবুন, ৮৮ হাজার সন্ত্রাসী হত্যা, ১৪১১টি ঘাঁটি ধ্বংস, ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি অবস্থানকে টার্গেট, ৪০ হাজারের বেশি বোম্বিং মিশন পরিচালনা, ৩ লাখ ৬৫ হাজার মানুষের নিহত হওয়ার মতো সংখ্যা ও অঙ্কগুলো কত অকপটে তুলে ধরা হলো! যেন বাচ্চাদের হাতে সচল কোনো ভিডিও গেমস শেষের অসমাপ্ত যোগফল! যেন এখানে প্রকৃতই মানুষের জীবন ও রক্তের কোনো ব্যাপার নেই! যেন এই অস্ত্র ও হত্যাদম্ভের হিসাব নেওয়ার জন্য কোথাও কেউ নেই! এবং কোথাও কেউ থাকবেও না! যেন এই মানুষবিনাশী যজ্ঞের সঙ্গে অপরাধের কোনো সম্পর্কই নেই। যেন কেবল ফুটানি আর বড়াইয়েরই একেকটি অংক!

সিরিয়ায় রাশিয়া যাদেরকে মেরেছে তারা কি সন্ত্রাসী? তারা সবাই কি সন্ত্রাসী? বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যারা সশস্ত্র লড়াই করছে, রাশিয়ার ভাষায় যদি তাদের সবাইকে সন্ত্রাসী ধরেও নেওয়া হয়- তাতেও কি রাশিয়ার ৪০ হাজার বোম্বিং মিশনের বৈধতা চলে আসে? দামেশক, হালাব, আলাসকাসহ সিরিয়ার যেসব শহর বোমায় বোমায় ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, বাড়িঘর-ভবন ধ্বংসস্তুপ ও কঙ্কালে পরিণত হয়েছে, সেইসব শহরের সবাই কি সন্ত্রাসী ছিল? নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, রুগ্ন-প্রতিবন্ধী সবাই? ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে যে হাজার হাজার নারী-শিশুর ক্ষত-বিক্ষত দেহ উদ্ধার হয়েছে, স্তুপিকৃত কংক্রিটের নিচ থেকে যেসব মাসুম বাচ্চার চিৎকার ভেসে আসতে আসতে থেমে গেছে- তারা কি সন্ত্রাসী ছিল? রাশিয়ার ৪০ হাজার বোম্বিং মিশন তাহলে কাদের উপরে ছিল? কাদের বিরুদ্ধে ছিল?

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে লাখ লাখ সিরিয়ান আশ্রয় নিয়েছে- যাদের পরিবারের একজন-দুজন-তিনজন-চারজন বোমায় ধ্বংস হওয়া স্তূপের নিচে হারিয়ে গেছে, তারা সবাই কি সন্ত্রাসী? বাড়িঘর, মসজিদ, লাইব্রেরি, হাসপাতাল, গোরস্তান রাশিয়ান বোমার বিনাশ থেকে তো কিছুই বাঁচেনি। সেখানকারও সবাই কি সন্ত্রাসী ছিল? সেইসব জায়গাও সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি ও অস্ত্রাগার ছিল?

Image result for russian attack in syria

প্রশ্নের শেষ নেই। উত্তরও অজানা নেই। যারা সিরিয়াকে ধ্বংস করেছে, জেদ-উত্তেজনা ও আনন্দে ধ্বংস করেছে। তা না হলে ১ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি বোম্বিংয়ের টার্গেট হতে পারে কীভাবে? কল্পনা করাও কঠিন। বৃটেন ভিত্তিক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, সিরিয়ায় ৭ বছরের যুদ্ধে ৩ লাখ ৬৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। কিন্তু উদ্বাস্তু  শরণার্থী হয়েছে কত লাখ, এতিম ও বিধবা হয়েছে কত লাখ- সে সংখ্যাটা উল্লেখ করা হয়নি। বড় একটি প্রশ্ন বারবার বড় হয়েই আসে- সিরিয়ায় পক্ষ-বিপক্ষের হয়তো অনেক জটিলতা আছে, কিন্তু একটি বংশানুক্রমিক স্বৈর শাসনকে টেকানোর জন্য এত বড় যুদ্ধ ও হত্যাযজ্ঞে বাইরে থেকে  রাশিয়া এবং রাশিয়ার বিপরীতে আমেরিকার যেতে হবে কেন? বোম্বিং ও টার্গেটের এত লম্বা পরিসংখ্যান দাঁড় করাতে হবে কেন? দাঁড় করালেও সেটা আবার সদম্ভে বলতে হবে কেন? রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের খবরটি চোখে পড়ার পর মনে হয়েছে, এখানে জিঘাংসা ও লোভ এবং ঝাল ও উল্লাসের কোনো ব্যাপারও হয়তো আছে। আমাদের মতো অভাজনদের যা বোঝার সামর্থ্য নেই।

শকুন পরাশক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিযানে সবুজ ও ঐতিহ্যময় সিরিয়া এখন এক কঙ্কালসার গোরস্তান। সেই গোরস্তানের পাহারাদার কে থাকবে- তার লড়াইয়েই লাখ লাখ মানুষ ও জীবন বোম্বিং মিশনের মুহূর্মুহু টার্গেট। কেউ থামানোর নেই। কেউ থেমে যাওয়ারও নেই। কেউ দেখার নেই। কেউ দেখানোরও নেই। উম্মাহর এক দুঃসহ এতিম সময় যাচ্ছে। এ জন্যই একটি পরাশক্তির নির্বিচার মানুষ খুন ও খুনের দম্ভের পরিসংখ্যান আজ গোটা দুনিয়াকে দেখতে হচ্ছে অসহায় চোখে। শুধু নিহতদের সঙ্গে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা লাগিয়ে দিয়ে সবকিছুকেই বৈধ করে নেওয়া হয়েছে।

Image result for russian attack in syria

রাশিয়ান প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ওই বক্তব্যের আরও কিছু বাক্য। তার অভিব্যক্তি ছিল, ‘সিরিয়ার যুদ্ধে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে রুশ সেনারা যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। পুরো যুদ্ধ জুড়েই ছিল আধুনিকতম অস্ত্রের মহড়া।’ হায়! আকাশ থেকে বোমা মেরে, দূর থেকে ক্ষেপনাস্ত্র ছুড়ে যারা একটি দেশের প্রায় সবকটি শহরকে ঝাঝরা করে দিয়েছে, তারাই নাকি যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে! বাঁধাহীন নির্বিচার মানুষ হত্যার অভিজ্ঞতা যুদ্ধের কেমন অভিজ্ঞতা, জানি না। তবে হত্যার অভিজ্ঞতা তো অবশ্যই। আফসোসের ব্যাপার হলো, রাশিয়া কিংবা রাশিয়ার মতো অন্য যে কোনো শক্তির বোমা মেরে মানুষ হত্যার অভিজ্ঞতার সাধ মেটানোর জন্য কার্যকর কোনো রাষ্ট্রশক্তি মুসলিম উম্মাহর নেই। উম্মাহর যেসব রাষ্ট্রশক্তির ভূমিকা রাখার কথা ছিল, তাদেরই কেউ কেউ আজ নিজ দেশের ভিন্নমতের নাগরিক হত্যা নিয়ে লেজেগোবরে দশার অভিজ্ঞতায় জান বরবাদ করছে। উম্মাহর যেসব রাষ্ট্রশক্তি পাহাড় পরিমাণ টাকার অস্ত্র কেনে, বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন মুদ্রায় সেনা পোষে- তাদের বেশির ভাগই এসব কিছুর সাহায্যে কেবল নিজের দেশের মানুষকে বন্দুকের সামনে রেখে মসনদ নিরাপদ রাখতে চায় । মুসলিম হত্যার অভিজ্ঞতা অর্জন করে যারা দম্ভ জাহির করে- তাদের ‘অভিজ্ঞতা’ বাড়িয়ে তোলার সাহসই এসব রাষ্ট্রশক্তি করে না।

সিরিয়ায় এক রাশিয়ার বোমা-দম্ভই এ আলোচনার মূল কথা নয়, যে কোনো মুসলিম দেশে যে কোনো বোমা বর্ষণকারী পরাশক্তির দম্ভ-অভিজ্ঞতার বিলুপ্তি এ আলোচনার মূল বিষয়, প্রধান আকাঙ্ক্ষা। এর জন্য প্রয়োজন মুসলিম দেশে দেশে উম্মাহ দরদি রাষ্ট্রশক্তির উন্মেষ। এর জন্য দরকার সচেতন উম্মাহ দরদি ঐক্যের জাগরণ।

পূর্ববর্তি সংবাদআন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য রোহিঙ্গা সঙ্কট একটি বড় পরীক্ষা : রাষ্ট্রপতি
পরবর্তি সংবাদপঞ্চগড়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অপহরণের চেষ্টা