জোটের রাজনীতিতে আদর্শ কতোটা মুখ্য?

আতাউর রহমান খসরু ।।

বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতিতে ‘ইসলাম’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্ট। তাই জাতীয় নির্বাচন সামনে এলে বড় দলগুলো ইসলামি ভোট ব্যাংকের অংশিদার হওয়ার জন্য শুরু করে নানান কসরৎ। বিশেষত বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের নির্বাচনকালীন ধর্মাচার বেড়ে যায় চোখে পড়ার মতো। এর মধ্যে হজ্জ-ওমরা পালন থেকে শুরু করে অধিক পরিমাণে ধর্মীয় মাহফিলে অংশগ্রহণ পর্যন্ত বাদ যায় না কোনো কিছু। দৃষ্টি আকর্ষণের এসব চেষ্টা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ইসলাম’-এর গুরুত্ব প্রমাণ করে।

কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারছে না। বরং সময়ে-অসময়ে তাদের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে বার বার ক্ষমতায় যাওয়ার পথ মসৃণ করছে বড় দলগুলো। অন্যদিকে বড় দলের আচরণে হতাশ হয়ে ইসলামপন্থীরা কখনো গাঁট বাধছেন ডানের সঙ্গে, আমার কখনো উঠছেন বাম-আধা বামের মঞ্চে।পর‌যবেক্ষকরা মনে করেন, আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা ও স্বাতন্ত্রবোধ বিসর্জন দিয়ে ইসলামি দলগুলোর নড়ে সরে যাওয়ায় আখেরে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ইসলামি রাজনীতি, নষ্ট হচ্ছে তার ভবিষ্যত সম্ভাবনা।

এর ব্যতিক্রমও আছে। ডান বা বাম কোনো ধারার জোটে না গিয়েও স্বতন্ত্র রাজনীতি করছে অনেক ইসলামি দল। ক্ষমতার রাজনীতিতে তারা পিছিয়ে থাকলেও ডানে বাঁয়ে জোট না বাঁধার জায়গায় তাদের অবস্থানটা বেশ লক্ষনীয়।ভোটের রাজনীতিতে চূড়ান্ত সাফল্যের কোনো আলামত তারাও জাগিয়ে তুলতে পারছেন না। অনেক সময় তাদের এই একলাচলায় ইসলামি আদর্শের পক্ষের ভোট ভাগ হয়ে যাচ্ছে। ফলে লাভবান হতে পারছে না ইসলামি আদর্শের সমর্থক কোনো পক্ষই।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মাওলানা ইমতিয়াজ আলমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম রাজনৈতিক জোটের ক্ষেত্রে আদর্শিক মিল আবশ্যক কেন? ‘তিনি বলেন, শুধু আমরা না -যারা ইসলামি রাজনীতি করেন- তারা সবাই আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যই রাজনীতি করেন। তারা ক্ষমতায়ও যেতে চান আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য। এখন আদর্শিক মিল না থাকলে আদর্শ প্রতিষ্ঠা কীভাবে করবেন? সুতরাং রাজনৈতিক জোটের জন্যও আদর্শিক মিল থাকাটা প্রয়োজন।’

আরও পড়ুন : বিএনপির সঙ্গে কি ইসলামি দলগুলোর দূরত্ব বেড়েছে?

তার ভাষায় আদর্শিক মিল না থাকলে ঐক্যবদ্ধ রাজনীতি ইসলামি দলের নৈতিক অবস্থান ও স্বাতন্ত্রবোধকে দুর্বল করে দেয়। শরিক দলের অনেক অনৈতিক কাজের দায় মাথায় চলে আসে। সংঘাত দেখা দেয় চিন্তা ও আদর্শের জায়গায়।

তবে তার মতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো, ‘আগামী প্রজন্মের কাছে এ বার্তা পৌঁছানো হয় যে, রাজনীতিতে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আদর্শ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।’

মন্দের ভালো হিসেবে ইসলামি দলগুলোর বড় একটি অংশ বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছিলো। সময়ের ব্যবধানে তাদের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে শরিক কয়েকটি ইসলামি দলের। বিপরীতে কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতিসহ ইসলামপন্থীদের কয়েকটি দাবি মেনে নেয়ায় আওয়ামী লীগের প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়েছে কোনো কোনো ইসলামি দল ও রাজনীতিকের।

তাহলে কি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আর কোনো পার্থক্য নেই? আর স্বীকৃতির জন্যই বা আওয়ামী লীগকে কতোটা আপন ভাবার সুযোগ রয়েছে?

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ (কাসেমী)-এর ঢাকা মহানগরের সভাপতি মাওলানা মন্জুরুল ইসলাম আফেন্দি বলেন, ‘এ বিষয়ে খুব বেশি কথা বলার সুযোগ নেই। এতোটুকু বলবো, স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে অনেক বড় প্রাপ্তি। এজন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর শুকরিয়া আদায় করতে পারি। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি উল্লসিত হওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের কোনো কিছু যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়।’

তিনি মনে করেন, ‘স্বীকৃতির মতো বিষয়গুলোকে রাজনীতির ময়দানে টেনে আনা উচিৎ হবে না। কারণ, এতে উপকারের পরিবর্তে ক্ষতিই বেশি হবে।’

তবে ক্ষতির দিকগুলো নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

মাওলানা ইমতিয়াজ আলম একই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আমরা আদর্শের জায়গায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিশেষ পার্থক্য দেখি না। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যেমন ধর্মীয় পরিচয় স্বীকার করে না, জাতীয়তাবাদও ধর্মীয় পরিচয় স্বীকার করে না। কোনো দলের বিশ্বাসেই ধর্মের জায়গা নেই। তাই আমরা ইসলামি দলগুলোর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কারো সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার পক্ষে নই।’

তবে এই নেতা স্বীকার করেন, বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগ একটু বেশিই ধর্মহীন, উগ্র ও অত্যাচারী। তার ভাষায় ‘একটি সহনীয় এবং অপরটি অসহনীয়। আসলে কেউ বন্ধু নয়।’

মন্জুরুল ইসলাম আফেন্দিকে মাওলানা ইমতিয়াজের কথা কোট করলে তিনি বলেন, ‘বিএনপিকে আমরাও ইসলামি দল মনে করি না। তবে মন্দের ভালো মনে করি। বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতির ক্ষেত্রে পুরোধা আলেমরাই বিএনপিকে আওয়ামী লীগের তুলনায় ভালো মনে করেছেন। সে ধারাবাহিকতায় আমরা এখনও তাদের সাথে আছি। এছাড়া শুধু ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টা সামনে আনলেই পার্থক্যটা অনেক বড় হয়ে যাবে।’

ইসলামি দলগুলো বড় দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে সংসদে প্রতিনিধিত্ব ও ক্ষমতার অংশিদারিত্বকে যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেন। তারা বলেন, জাতীয় সংসদের প্রতিনিধিত্ব সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলামি দলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে এবং দলের অবস্থান দৃঢ় হবে। তা না করলে দলের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।

মাওলানা ইমতিয়াজ আলম বিষয়টির সঙ্গে একমত নন। তিনি বলেন, সংসদের প্রতিনিধিত্বের মূল্য তখন-ই থাকে যখন প্রতিনিধিদের উপর নির্ভরতা থাকে। নির্ভরতা না থাকলে সংসদ সদস্য হয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো উপকার হয় না।

মাওলানা মান্জুরুল ইসলাম আফেন্দির কথায়ও তেমন ইঙ্গিত মেলে। তিনি বলেন, ‘জামাতের বিরোধিতার কারণে স্বীকৃতি হয়নি জোট সরকারের আমলে।’ অর্থাৎ জামাআতে ইসলামীর বিরোধিতা উপেক্ষা করে তা পাশ করার মতো ক্ষমতা ছিলো না আমাদের।

দলের অস্তিত্ব প্রশ্নে ইসলামী আন্দোলনের নেতা ইমতিয়াজ আলম বলেন, ‘আমি মনে করি কোনো দলের সঙ্গে মিলে যদি আমার নিজস্বতা হারিয়ে যায় সেটাই একটি আদর্শিক দলের অস্তিত্ব হারানো। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে আসার নাম অস্তিত্ব হারানো না। কারণ তা এক সময় বাড়তেও পারে। কিন্তু আদর্শিক আস্থা হারালে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না।’

আরও পড়ৃন : ভোটের রাজনীতিতে কওমি স্বীকৃতির প্রভাব কতটা পড়বে

সম্প্রতি ইসলামি দলগুলোর আওয়ামী ঘনিষ্ঠতার প্রতি ইঙ্গিত করে মাওলানা আফেন্দি বলেন, ‘স্বীকৃতি বা অন্য আর যাই বলুন তার বিপরীতে সংবিধানে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস, আল্লাহ, রাসুল সা., কুরআন ও হাদিসকে কটাক্ষকারীদের শাস্তির বিধান এবং কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন না হওয়ার নিশ্চয়তা প্রদানের সমকক্ষ হতে পারে? কোনো দলের সঙ্গে আপস বা সমঝোতা হলে এসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করেই হতে পারে। অন্য কোনো বিষয়কে সামনে রেখে নয়।’

তিনি দাবি করেন, বিএনপির সঙ্গে এমন আশ্বাসের ভিত্তিতেই তারা জোটবদ্ধ হয়েছিলেন।

ড. কামালের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন এবং সেখানে ইসলামি দলগুলোর অবস্থান নিয়ে আলোচনা আছে বর্তমান রাজনীতিতে। এমন পরিস্থিতে বিএনপি কোনদিকে ঝুঁকবে? কামালদের বাম ধারার দিকে নাকি নিজের শরিক দলগুলোর ডান ধারায়?

এমন শঙ্কার উত্তরে মাওলানা আফেন্দি বলেন, ‘ড. কামাল নিজেই বলেছেন এ জোট অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনী জোট। ক্ষমতার অংশিদারিত্বের জোট না। সুতরাং এই শঙ্কার কোনো অর্থ নেই।’

সর্বশেষ মাওলানা আফেন্দিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ড. কামালের মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে আপনারা আদর্শিক বিষয়টি বিবেচনা করেছিলেন? তিনি বলেন, ‘কোনো অমুসলিম যদি আপনার পুকুরে মাছ ধরে এবং আপনি তার সঙ্গে জালে হাত দেন তাহলে কি আপনি অমুসলিম হয়ে যাবেন! আমরা একটি অভিন্ন লক্ষ্য থেকে এক মঞ্চে গিয়েছিলাম। এর বেশি কিছু নয়।’

এই জমিয়ত নেতা মনে করেন, তাদের অনুষ্ঠানে জমিয়তকে দাওয়াত দেওয়ার পরও অস্বীকার করে ড. কামাল নিজের নৈতিক দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছেন। কারণ, তিনি দাওয়াত দিয়েও সত্য স্বীকার করতে পারেননি।

পূর্ববর্তি সংবাদপৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বন্দীশিবিরে উইঘুর মুসলিমদের আটকে রেখেছে চীন
পরবর্তি সংবাদসংবিধান প্রণেতা এখন নষ্ট রাজনীতির প্রবর্তক : ওবায়দুল কাদের