কেলান্তান অর্থ হলো আলোকিত ভূমি। মালয়েশিয়ার নয়টি প্রদেশের অ্যতম একটি প্রদেশ এটি। মালয়েশিয়ার উত্তরপূর্ব কোণে অবস্থিত এই প্রদেশ। উত্তর প্রান্তে থইল্যান্ডের নারাথিওয়াট সীমানা ঘিরে আছে।
পূর্ব-পশ্চিমে অবস্থিত শরিয়া আইন কার্যকরী আরেকটি প্রদেশ তেরেঙ্গানু। কোটা ভারু হচ্ছে প্রাদেশিক রাজধানী। প্রদেশটির অফিসিয়াল ইসলামি উপাধি হচ্ছে দারুন-নাঈম। প্রায় প্রতিটি প্রদেশেরই সন্মানসূচক একটি ইসলামি উপাধি আছে। যেমন আরেকটি প্রদেশ সেলাঙ্গরের উপাধি হচ্ছে দারুল ইহসান।
ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি : কৃষিপ্রধান প্রদেশ। তাই মূল রাজধানী ব্যতীত সর্বত্রই গ্রাম বংলার আবহ বিরাজমান। গ্রামীণ সংস্কৃতি পাত্বানি প্রভাবিত। তবে প্রদেশটি মুসলিম পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণীয়। রয়েছে পানিতে ভাসমান ও দৃষ্টিনন্দন সব মসজিদ, চোখ জুড়ানো স্থান ও স্থাপনা, প্রাচীন মুসলিম সুলতানদের কাঠের রাজপ্রাসাদ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিসম্বলিত জাদুঘর। উল্লেখযোগ্য স্থান হলো, ইসতানা জাহার, সুলতানের প্রাসাদ।
তবে ভাসমান মসজিদ মসজিদ মুহাম্মাদিই পর্যটকদের আকৃষ্ট করে বেশি। মসজিদটি নির্মিত হয় ১৮৬৭ সনে। মসজিদটিকে অন্য নামেও ডাকা হয় Serambi Mekah বা মক্কার পথে।
কথিত আছে, মূল মালয়ী সংস্কৃতির ধারক হচ্ছে কেলান্তান। কৃষিনির্ভর প্রদেশ তাই সাধারণত জীবিকা নির্বাহের মূল মাধ্যম হচ্ছে ধান চাষ, রাবার উৎপাদন, হস্তশিল্পীও বেশ প্রসিদ্ধ। খাবার-দাবারে হরেক রকমের নাম রয়েছে। তবে উলাম হচ্ছে বেশ পরিচিত।
দৈনন্দিন জীবনে সবাই মসজিদমুখী। সামাজিক জীবনে মসজিদ অনেকটা পঞ্চায়েতের মতো। যেন মসজিদভিত্তিক জীবনব্যবস্হা। সামাজিক প্রায় সব অনুষ্ঠান মসজিদে বা মসজিদের নির্ধারিত আঙিনায় হয়ে থাকে। এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানও মসজিদের আঙিনায় অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় প্রতি নামাজের পর মসজিদের বারান্দায় কোনো না কোনো খাবার, ফলমূল সাজানো থাকে। কখনও দাতার নাম জানা যায়, কখনও পরিচয় গোপন রেখে প্রভুর প্রতিদান প্রাপ্তির প্রতিযোগিতাও পরিলক্ষিত হয়।
রাজনীতি ও শরিয়া আইন : তবে প্রদেশটির রয়েছে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ইতিহাস। ৯৫ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় রাজনীতিতে এই প্রদেশের রয়েছে বিশেষ অবস্হান। মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি প্রাদেশিক শাসনক্ষমতা লাভ করে আসছে ইসলামি রাজনৈতিক দল PAS (পার্টি আগামা সে-মালয়েশিয়া)।
মালয়েশিয়ার মোট চৌদ্দটি প্রদেশের নয়টি প্রদেশ একেকজন প্রধানমন্ত্রী দ্বারা পরিচালিত হয়। এই মন্ত্রী ক্ষমতাসীন দলের হতে পারে আবার বিরোধী দলেরও হতে পারে। তাই মালয়েশিয়ার বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের বাইরেও কয়েকজন মন্ত্রী ৩টি প্রদেশ শাসন করে। দুটি প্রদেশ ইসলামি রাজনৈতিক দল দ্বারা পরিচালিত, তেরেঙ্গানু এবং কেলান্তান।
প্রদেশগুলোর প্রত্যেকটিরই আলাদা রাজা এবং সেনাবাহিনী রয়েছে। মসজিদগুলোতে এখনও জুমুআর খুতবায় সুলতানের জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়। কেলান্তানে প্রশাসনিকভাবে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠিত, যার চূড়ান্ত রূপ হলো ‘হুদূদ ও ক্বিসা’। নামাজের সময় বাজারের দোকানগুলো বন্ধ রাখতে হয়। এক্ষেত্রে কঠোরতা না থাকলেও নামাজ চলাকালীন সময়ে কাউকে রাস্তায় পেলে টহলরত পুলিশ গাড়িতে উঠিয়ে মসজিদে নিয়ে যায়। জুমআর নামাজে বাধ্যতামূলক দোকানপাট বন্ধ থাকে। তবে বর্তমান প্রদেশটির বিচারক জানিয়েছেন, তারা হুদূদ কার্যকরের ক্ষেত্রে আরও গবেষণা চালাবেন। এক্ষেত্রে তারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারকে সামনে রেখে কাজ করছেন।
প্রসঙ্গত, ফিকহি মাসআলায় ড. ইউসুফ আল কারজাভির ফতওয়াই এখানে প্রণিধানযোগ্য। প্রদেশটির বর্তমান মন্ত্রী পাস পার্টির আহমাদ ইয়াকুব ।
আরও পড়ুন : কেমন চলছে মালয়েশিয়ার মাদরাসাশিক্ষা
দ্বীনি শিক্ষাব্যবস্হা : কেলান্তানে ভারত উপমহাদেশের মতোই দ্বীনিশিক্ষার জন্য রয়েছে সরকারি বেসরকারি মাদরাসা। আবাসিক আনাবাসিক দু রকমেরই প্রচুর মাদরাসা রয়েছে। তবে পন্ডক হচ্ছে বিশেষ ধরনের মাদরাসা। এ যেন ইলমে নববির সোনালি যুগ ফিরিয়ে আনার ছোট্ট এক প্রয়াস। রড-সিমেন্টের কোনো দালান নয়, কাঠের অর্ধ দেয়াল আর খড়ের ছাউনি, কখনও বা সাধারণ কাঠ আর কার্ডবোর্ডের নির্মিত বাড়ি। মসজিদে দরস প্রদান করা হয়, আবার কখনো নির্ধারিত শ্রেণিকক্ষে। কোনো কোনো পন্ডক মাদরাসায় খাবার-দাবারের বিশেষ কোনো ব্যবস্হা থাকে না, তালিবুল ইলমদের নিজেদের রান্না করে খেতে হয়।
তাছাড়া সাধারণ মাদরাসাও রয়েছে প্রচুর। শিক্ষক এবং মুরিদের (সাধারণত ছাত্রদের মুরিদ বলা হয়) মধ্যে রয়েছে কওমি মাদরাসার মতোই উৎসর্গপ্রাণ ভালোবাসা, যা অন্যান্য প্রদেশগুলোতে তেমন একটা লক্ষ করা যায় না। উল্লেখেযোগ্য মাদরাসাগুলোর কয়েকটি হলো মাদরাসা দ্বীনিয়্যাহ বাকরিয়্যাহ পন্ডক পাসির, তুম্বুহ; মাদরাসা তাহফিজ দারুল কুরআন ওয়াল কিরাত, পাসির মাস; মাদরাসা তাহফিজ আল কুরআন ওয়াল আসরিয়্যাহ, পাসির মাস, কেলান্তান।
ফিচার ইমেজ : gettyimages