আরমান : মনে আছে কিশোরগঞ্জের সেই কিশোর শহীদের কথা?

আমিন আশরাফ  ।।  

কিশোরগঞ্জে টানা তিন দিন ধরে চলছে মুষলধারে বৃষ্টি। মাঝে মাঝে নামাজের সময় বিরতি পাওয়া যায়। এছাড়া বিরাম নেই। জোহরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৃষ্টির গতি। বের হয়ে অভ্যাসমাফিক বাগে জান্নাত কবরস্তানের দিকে হাঁটা দিলাম। কবরের দিকে তাকিয়ে হাঁটছি আর ভাবছি, শুয়ে থাকা মানুষগুলো ওপারে কেমন আছে?

হঠাৎ চোখ গেল একটা কবরের দিকে। মনে মনে এই কবরটাই খুঁজছিলাম। বৃষ্টিতে ততক্ষণে শরীর ভিজে একাকার। কিন্তু কবরটা দেখার পর আমি নিজের কথা ভুলে গেলাম।

কবরের এপিটাফে লেখা : ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না বরং তারা জীবিত,কিন্তু তোমরা তা বোঝো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৩)

লোহার গ্রিল দিয়ে কবরটা প্রাচীরঘেরা। শহীদ খেতাব পাওয়া আরমান এখানে পরম শান্তিতে শুয়ে আছেন। শহীদের কবর জিয়ারত করে কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। জিয়ারতকারী লোকজন আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। বাড়ছে বৃষ্টির তীব্রতা। আকাশটা আরো অন্ধকার হয়ে আসছে। দেখতে দেখতে কবরস্থানে আসা শেষ লোকটাও চলে গেল।

বাগে জান্নাত কবরস্তানে শহীদ আরমানের কবর

২৩ বছর ৪ মাস আগে

আমার বয়স তখন চার বছরের বেশি হওয়ার কথা নয়। আব্বু বললেন, ‘আজ  মাদরাসায় যেতে হবে না। আজ  (৩০ জুন ১৯৯৪) তসলিমা নাসরীনের ফাঁসি চেয়ে  হরতাল ডেকেছে দেশের সব আলেম-উলামা।’

আব্বু বাসা থেকে বেরুতেই কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে একরামপুর পেরিয়ে পুরানথানার কড়ই গাছের নিচটাতে এসে দাঁড়ালাম। তখনই কিছু লোককে দৌড়ে পালাতে দেখলাম। কী হয়েছে বুঝতে পারছিলাম না। একজন পালাচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে, ‘সবাই পালাও, পুলিশ গুলি করে একজনকে মেরে ফেলেছে।’

লোকটির কথা শোনে দৌড়াদৌড়ি আরও বেড়ে গেল। আমরাও ভয়ে,দৌড়ে বাসায় চলে এলাম। পরের দিন এগারোটায় আব্বুর সঙ্গে শহীদী মসজিদের সামনে গিয়ে দেখি, কফিনে একটা রক্তেভেজা লাশ মসজিদের চত্বরে রাখা। লাশটা আরমানের। গতকাল সে-ই মারা গেছে।

লাশের নিচের অংশে রক্তে ভিজে ছোপ ছোপ হয়ে আছে। কিছু রক্ত মাটিতেও পড়ছে। লাশটাতে এত রক্ত কেন? আব্বু বললেন,শহীদের লাশ ফেরেশতারা গোসল করায়। আমি তাকিয়ে থাকি।

আরমান শহীদ হওয়ার কারণে সারা কিশোরগঞ্জ কয়েকদিন যাবত ছিল উত্তাল।মিছিল-মিটিংয়ের কারণে কয়েকদিন মাদরাসার ক্লাসও বন্ধ ছিল।

এরপর কত বসন্ত চলে গেছে, এসেছেও। আস্তে আস্তে জানতে পারি, আরমান কেন শহীদ হল। কিন্তু ইতিহাস কি শহীদ আরমানকে মনে রেখেছে? নাকি জান্নাত-গোরস্তানে শুয়ে থাকা আর দশজন মৃতের মতো আরমানও হারিয়ে গেছে স্মৃতির ডায়েরি থেকে? সে তো আল্লাহর কাছে তার শহীদ হওয়ার পুরস্কার পাবে,তাকে ভুলে যাওয়ার কী পুরস্কার অন্যেরা পাবে?

ঈশাখাঁ রোড জনতা ব্যাংকের সামনে। এখানেই আরমান গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।

গাজী আশরাফ যা বললেন 

শহীদী মসজিদের উত্তর গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে আরমানদের বাড়ি। তার বাঢ়িতে যাওয়া মানে কোনো শহীদের বাড়ি যাওয়া।প্রথম দিন সে বাড়িতে গিয়ে ভেতরে খুব গর্ব অনুভব করেছিলাম। বলা যায়, তখন থেকেই শোলাকিয়া গেলে বাগে জান্নাত কবরস্তানে আরমানের কবরটা দেখে আসতাম।

মাদরাসার ইলেকট্রিশিয়ান গাজী আশরাফ ভাই। আরমান শহীদ হওয়ার সময় তারা দুজন একসঙ্গে ছিলেন মিছিলে।হরতালের মিছিল ছিল,নাস্তিক লেখকের শাস্তির দাবিতে মিছিল ছিল।দুজনই গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। আরমান শহীদ হলেন,আর তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেন। এজন্যই গাজী উপাধি পাওয়া তার।

আমরা তার কাছে জানতে চাইতাম সেই দিনের কথা। সেই সময়ের কথা। জানতে চাইতাম শহীদ আরমানের কথা।

ঘটনাটা তিনি বেশ সময় নিয়ে বলতেন। তার পাজরের হাড্ডিতে গুলিবিদ্ধ হওয়া স্থানটা আমাদের দেখাতেন। ক্ষতস্থানটা দেখে আমরা শিউরে উঠতাম। ইস! একটুর জন্য। আরেকটু গভীরে ঢুকলে তাকেও আরমানের সঙ্গী হতে হতো।

তিনি বললেন, ‘সেদিন আমরা মিছিল করে বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ গৌরাঙ্গবাজারের দিকে পুলিশের লাঠিচার্জের কথা শুনতে পেলাম। আমি আর আরমান প্রায় সমবয়সী। আরমান বলল, ইসমাঈল হুজুরকে পুলিশরা মারছে। চল, দেইখা আসি।

আমরা যখন ব্যাপারটা দেখতে জামিয়া ইমদাদিয়া পেরিয়ে জনতা ব্যাংকের সামনে এলাম তখনই গোলাগুলি শুরু হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরমান গুলিবিদ্ধ হল, আমিও পড়ে গেলাম। তারপর আর কিছু জানি না। সুস্থ হওয়ার পর জানতে পারি, আরমান না ফেরার দেশে চলে গেছে। আল্লাহর দয়ায় আমি এখনো বেঁচে আছি।’

শহীদ আরমানের জানাজায় হাজারো মানুষের ঢল

আরমানের বাড়িঘর

আকাশে রোদ নেই।চারপাশটা আজ  অন্যরকম। বাড়ির অবস্থাটাও আর আগের মতো নেই। আরমানদের বাড়ির সামনে অনেকগুলো দোকান হয়েছে। মাঝখানে একটা লোহার গেট। উপরে লেখা আছে, শহীদ আরমান ভিলা।

কলিং বেল খুঁজছিলাম। ফাস্টফুডের দোকান থেকে বের হতে দেখলাম লোকটাকে। আগে মনে করতাম এই লোকটাই সম্ভবত শহীদ আরমানের বাবা। আরমানের কথা বলতেই ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসালেন। বের করলেন পরিবারিক ফটো অ্যালবাম।

তিনি আরমানের চাচা নজরুল ইসলাম। আরমানের বাবা আনোয়ার হোসেন চার বছর আগে মারা গেছেন। আরমানের চার ভাইয়ের মাঝে বড় ভাই জীবিত আছেন।

আরমানের বয়স তখন ১৪ বছর। আজীমুদ্দিন হাইস্কুলের ৮ম শ্রেণীর ছাত্র। বাসার পাশেই শহীদী মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি। ছোটবেলা থেকেই সে নিয়মিত নামাজ পড়তো। স্কুলে নামাজ পড়ার কোনো জায়গা ছিল না। সে কয়েকজন সহপাঠীকে নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থানের ব্যবস্থা করিয়ে নেয়। দাওয়াত-তাবলিগ ছাড়াও আলেম-উলামার যে কোনো কর্মসূচিতে সবার আগে থাকতো সে।আর তার বন্ধুদের অধিকাংশ ছিল জামিয়া ইমদাদিয়ার ছাত্র।

চাচা নজরুল ইসলাম বললেন, ‘সে সময় দেশে ইসলামবিরোধী লেখালেখি চলছিল।পরিস্থিতি ভালো ছিল না।তসলিমা নাসরিন কুরআন পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছিল।কুরআন-হাদীস ও রাসুল সা.-এর বিরুদ্ধে কী কী লিখেছে। সেজন্য আলেম-উলামার পক্ষ থেকে ইসলাম ও রাষ্ট্রদোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চা হরতাল ডাকে। হরতাল পালন করার জন্য অনেক আগে থেকে প্রচার-প্রচারণা চলছিল।সেই হরতালে পরে দেশের সব আলেমরা সমর্থন দিয়েছিলেন।’

‘৩০ জুন সকালে আরমান ফজরের আজান শুনেই সবাইকে ডেকে তুলল। তার ডাক শোনে তার বাবা ও আমি ঘুম থেকে উঠে নামাজে যাই। নামাজ পড়ে আরমান বাসায় এসে মাকে বলল, আম্মু, মিছিল যাবো, কিছু খেতে দাও। মা ভয় পেয়ে বললেন, বাবা মিছিলে যাসনে। মিছিলে মারামারি হতে পারে। তুই ছোট! তোর যাওয়া লাগবে না বাপধন।’

‘আরমান বলে, মা আমি যাবোই। গতকাল সালাহউদ্দিন (জামিয়া ইমদাদিয়ার মুহাদ্দিস) হুজুরের কাছে জেনেছি, কুরআনের সম্মান রক্ষার জন্য মিছিলে গিয়ে কেউ মারা গেলে সে জান্নাতে যাবে। মা মানা করলেও আরমান ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দুপুরে ফিরে আসে লাশ হয়ে।’

আরমানের চাচা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে মিছিল শেষ করে চলে আসছিলাম। হঠাৎ জানতে পারলাম, গৌরাঙ্গবাজারের দিকে পুলিশ মুসল্লিদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে। অনেকে মারাত্মক আহত হয়েছে। পীর ইসমাঈল সাহেবও মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন।

‘আরমান ইসমাঈল সাহেবের আহত হওয়ার কথা শুনে দৌড়ে চলে গেল। দুপুরের দিকে শুনলাম, একটা ছেলে গুলিতে মারা গেছে। তার বাসা নাকি শহীদী মসজিদের পেছনে। কিছুক্ষণ পর খোঁজ পড়ল আরমানের। আরমান কই, আরমান কই…! এক ছেলে এসে জানাল, পুলিশের গুলিতে আরমান মারা গেছে।’

‘আরমানের শহীদ হওয়ার খবর শুনে শহরবাসী ক্ষোভে ফেটে পড়ে । মিছিলে মিছিলে শহর উত্তাল হয়ে যায়। রাজনৈতিক অনেক সুবিধাভোগীরা থানায় হামলা করার প্ররোচনা দিচ্ছিল লোকদের। মাওলানা আনোয়ার শাহ সাহেব লোকদের বুঝিয়ে থামাতে সক্ষম হন।’

‘আরমানের লাশ মর্গে পড়েছিলো অনেকক্ষণ।লাশ দিতে চাচ্ছিল না কর্তৃপক্ষ। শহরের গণ্যমান্য লোক গিয়ে লাশ বাসায় নিয়ে আসে।’

জানাজাপূর্ব অভিব্যক্তি ব্যক্ত করছেন মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ.। সঙ্গে আছেন আযহার আলী আনোয়ার শাহ, সাবেক এমপি মাসুদ হিলালী, মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ., মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ. ও অন্যান্যরা।

আরমান কি কোনো দল করতো?

‘আরমানের শাহাদাতের খবর পেয়ে ইসলামি দলের নেতারা আসেন। আসেন ছাত্র মজলিসের লোক। তারা বলতে থাকেন, আরমান ছাত্র মজলিস করতো। এলো শিবিরের লোকজনও। তারাও বলতে লাগল, আরমান শিবির করতো। আমরা বলেছি, আরমান কোনো দলই করতো না। বয়স মাত্র চৌদ্দ বছর। দল বোঝার মতো তো বয়সই হয়নি।’

‘আমরা না করার পরও চট্টগ্রামের নেজামে ইসলামীর নেতারা কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে গেছে। তখনকার দেশের বড় সব নেতাই আমাদের ঘরে এসেছেন। খোঁজ-খবর নিয়েছেন। আমাদের সান্ত্বনা দিয়েছেন। বলেছেন, আরমানের রক্ত বৃথা যাবে না। আরমান শহীদ হয়েছে। আরমানের স্থান জান্নাতে।’

আরমান সত্যিই কি কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিল? বিষয়টি জানতে কথা বলেছিলাম কিশোরগঞ্জস্থ পুরানথানার টেলিকম ব্যবসায়ী মাওলানা এহতেশামুল হক সারোয়ারে সঙ্গে। তিনি বলেন, তখন আমি মাদরাসায় নাহবেমির জামাতে পড়ি। শহীদী মসজিদের পশ্চিমে বধুয়া কমিউনিটি সেন্টারে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিসের বিভিন্ন প্রোগ্রাম হতো। ছাত্র মজলিস সদস্য সংগ্রহ করার সময় আরমান তাদের একটা ফরম পূরণ করেছিল। সে হিসেবে ছাত্র মজলিসের দায়িত্বশীলরা দাবি করে, আরমান তাদের কর্মী ছিল। অথচ সে অনেক ছোট ছিল। দলবল সম্পর্কে তার ধারণাই ছিল না।

 

লাখো মানুষের ঢল

পরের দিন শোলাকিয়া মাঠের প্রায় পুরোটাই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। জানাজায় ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা প্রতরেোধ মোর্চার অনেক নেতা এসেছিলেন। এসেছেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মুফতী আমিনী, কটিয়াদীর মেজর আখতারুজ্জামান রঞ্জনসহ অনেক গণমান্য রাজনৈতিক নেতা। তারা জানাজাপূর্বক আলোচনায় আরমান হত্যাকারীর ফাঁসির দাবি করেন। জানাজার নামাজ পড়ান জামিয়া ইমদাদিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা আনোয়ার শাহ।

আরমানের উপর গুলিবর্ষণকারী পুলিশ কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল বলে জানান আরমানের চাচা নজরুল ইসলাম। সরকার এ বিষয়ে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি এবং সেই পুলিশের আর কোনো শাস্তি হয়েছিলো কি না তাও তিনি জানেন না বলেন।

বেসরকারিভাবে আলেমদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে তারা প্রায় চল্লিশ হাজার টাকার মতো সহযোগিতা পেয়েছেন। তবে তাঁর কথায় জানা গেছে, আরমানের শহীদি মৃত্যু হওয়ায় এর বিচার নিয়ে তারা তেমন একটা মাথা ঘামাননি। আল্লাহ তায়ালা আরমানকে শহীদ হিসেবে কবুল করেছেন এটাই তাদের পরম প্রাপ্তি।

শহীদ আরমানের বাবা আনোয়ার হোসেন

শহীদ আরমান সড়ক

আরমান যে সড়কে শহীদ হয়েছিল, সে সড়কটা শহীদ আরমান সড়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয় আরো অনেক বছর পরে। চাচা নজরুল ইসলাম বলেন, পৌরসভার কাগজে-কলমে আরমান সড়ক থাকলেও বর্তমানে আরমান সড়কের কোনো নামফলক নেই। রাস্তা মেরামত করার সময় ফলক ভাঙার পর আর কেউ ফলকটা দাঁড় করায়নি।

নামফলকের মতো শহীদ আরমানের স্মৃতিও অনাদরে পড়ে আছে ইতিহাসের কোনো কানাগলিতে। তার জীবনদানের কারণে এ দেশ থেকে বিতাড়িত হয় তসলিমা নাসরীনের মতো পাপিষ্ঠ নারী। ইতিহাসে তার আত্মদান অমর হয়ে থাকবে। কোনোদিন মুছে যাবে না।

পূর্ববর্তি সংবাদএ বেলার ছুটিতে আব্বু, আপনাকে মনে পড়ছে
পরবর্তি সংবাদতুরস্কের দূতাবাসেই খাশোগিকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে সৌদি