এ বেলার ছুটিতে আব্বু, আপনাকে মনে পড়ছে

আতাউল মুনঈম লাবীব  ।।  

ছোটো বেলায় পাড়ার মকতবে সজোরে ‘ওয়াল ক্বাদরি খাইরিহি ওয়া শাররিহি মিনাল্লাহি তায়ালা’র যে গুঞ্জন আমার কানে লেগে অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিলো, সে বিশ্বাসকে বুকে ধারণ করেই জীবনের কতগুলো সময় পার করে এসেছি। ভাগ্যের সঙ্গে বোঝাপড়া আর তার কাছে বারেবারে হেরে যাবার তীব্র যাতনা সয়ে নিয়ে হলেও বিশ্বাস করে নিয়েছি এ ভাগ্যের মালিক তো স্বয়ং মাওলাপাক। তিনি লিখে রেখেছেন যা, তাই তো হচ্ছে। হবে প্রতিনিয়ত। এর বিরুদ্ধতা করার শক্তি কি আছে আমাদের?

মাদ্রাসা বন্ধ হলো। ছুটি এলো। যেন এলোমেলো সব এখনের ছুটিগুলো। প্রাণহীন। নির্জীব। কোথাও কেউ নেই রকমের শূন্যতা চারোদিকে। ভাবনার ঊর্ধ্বে থাকা এসব ছুটিছাটার কথা কি কখনও ভেবেছি? ভাবনায় কি কখনও ছিলো এরকম আনন্দময়তার ভেতরে কোনো দুঃসহ সংবাদ প্রাচীর তুলে দিবে আমাদের অন্তরালে। অকল্পনীয় ছিলো সত্যিই৷ গত ছুটিতেও আব্বুর সঙ্গে আমরা সবাই। প্রাণবন্তভাবে ছুটির দিনগুলো কাটালাম। মফস্বলি ময়মনসিংহ ঘুরেফিরে অনুভব করলাম কত আনন্দ। কিন্তু ক’টা মাত্র দিনের পরিবর্তনে আমাদের জীবনে নেমে এলো অবসাদ আর সুতীব্র বেদনার রোনাজারি। নেমে এলো ভীষণ শূন্য মরুদ্যানে ছুটির একেকটি অনুগ্রাহী দিন।

নরসিংদীতে বাড়ির উঠোনে আব্বুর সুনিপুণ হাতে গেঁথে আসা সে বাগান, যেখানে আছে বোগেনভিলাস আর রজনীগন্ধার মত সুডৌল বক্ষ উজার করে দেয়া ফুল ফল বৃক্ষ, তা নিয়ে আমাদের কতো আশা আকাঙ্ক্ষার কথা; সবকিছু কেবলমাত্র কল্পনার করিডোরে ভাসমান কিছু খাব। এ ছাড়া আর কি! কথা ছিলো এ বন্ধেও বাড়ি যাওয়া হবে। বাগানের মাঝখানে গজিয়ে ওঠা আগাছা আর একটু গোছালো পরিবেশে আমাদের স্বপ্নের প্রাসাদটাকে বর্ণিল রূপ দেয়া, সবই ছিলো এ বন্ধের কর্মশালা। গত ছুটিতে যখন এবারের ছুটির প্ল্যান তৈরি করছিলাম, তখনও কি আমাদের ভাবনায় এসবের সায় ছিলো?
“আব্বু, এদিকটায় অনেক আগাছা জমে গেছে। আগামী ছুটিতে এসে এসব কেটেছিড়ে পরিস্কার করতে হবে।
একটু মিষ্টি হেসে আব্বু, হাঁ হাঁ” এইযে কালামটুকু পিতা-পুত্রের, তার সঙ্গে জীবনের কী ছন্দপতন, আহা! ভাগ্যের সঙ্গে হেরে গিয়ে যেন সেসব চিত্রপট পালটে দিচ্ছি ক্রমশ। বেলকনির রংচঙা গ্রিলে হাত রেখে এখন তো আর কেউ বলবেন না নিশ্চয়ই, লাবীব, ঘরে চলে এসো। রোদ করেছে খুব। একটু কমলে না হয় আবার যেয়ো!

আমাদের ছুটিগুলো আগের মতোই চলবে। কিন্তু এ অনুভব যেন শুধুই ক্বলবে। ক্বলবের খুব গভীরে। ফুল গাছ আর নরোম ঘাসের পাশে থাকা আগাছা, সব কেটেছিড়ে পরিস্কার করা হবে নিশ্চিত, তবে একটু অন্যভাবে। মস্তিষ্কের আছে যত নিউরন, তার মিশেলে, নীরব যন্ত্রণায়। বাঁশ বাগানটি পেরিয়ে মাদ্রাসার দেয়াল ঘেঁষে যেখানে শুয়ে আছেন আমার আব্বু, সেখানটাতে একটু নরম পদক্ষেপে হয়তো আমরা হেঁটে যাবো। কবরের উপরে গজে ওঠা সেসব পরগাছা, সব কেটে স্বর্গের বাতাস বইয়ে দেবো৷ যে স্বর্গে তিনি আছেন, থাকবেন চিরকাল।

[আতাউল মুনঈম লাবীব সদ্যপ্রয়াত বিশিষ্ট আলেম ও লেখক মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াসেল রহ.- এর সুযোগ্য সন্তান।]

পূর্ববর্তি সংবাদভালোবাসা নিয়ে টোকিও শহরে ঘুরে বেড়ান শায়খ নেয়ামাতুল্লাহ
পরবর্তি সংবাদআরমান : মনে আছে কিশোরগঞ্জের সেই কিশোর শহীদের কথা?