ইসলাম টাইমস ডেস্ক : আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর পতন ঘণ্টা শুনতে পারছে অনেকেই। আফগানিস্তানে তালেবানের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি, মার্কিন সরকারের আপোষ চেষ্টা ও কাবুল সরকারের ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে ক্রমেই মার্কিন বাহিনীর পতন-চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ধারণা করা হচ্ছে, ‘সাম্রাজ্যবাদীদের কবরস্থান’ নামে পরিচিত দেশটিতে সর্বশেষ ব্যর্থ বিদেশী শক্তি হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্র।
গত সপ্তাহ দুয়েক আগে রাজধানী কাবুল থেকে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণের কৌশলগত শহর গজনি কয়েক দিনের জন্য তালেবানরা দখল করে রেখেছিল। আবার সামরিক গোয়েন্দা ঘাঁটিতে আকস্মিক আক্রমণ করার মতো ঘটনাও এ সময় ঘটছে। যা মার্কিনসমর্থিত নিরাপত্তা বাহিনীর অকার্যকারিতাকে প্রমাণ করে।
কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান গজনিতে তালেবান হামলা পরিস্থিতির ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। তালেবানদের এই হামলা যতটা সামরিক, ঠিক ততটাই প্রতীকী।
আফগানিস্তানে একদিকে তালেবানরা গোপনীয় ও অপ্রকাশিত শান্তি আলোচনার সংবাদ থেকে মনে হচ্ছে ১৭ বছরের দীর্ঘ যুদ্ধের হয়তো ইতি ঘটতে চলেছে। অন্যদিকে তালেবানরা এখানে সফলভাবে মার্কিন সব ধরনের সামরিক আগ্রাসনকে প্রতিহত এবং স্থানীয় ও বিদেশী সেনাদের হামলার মোকাবেলা করেছে।
আফগান সরকার এবং মার্কিন বাহিনীও এখনো আক্রমণাত্মক অবস্থানে রয়েছে। সর্বোপরি দোহা আলোচনার আগ দিয়ে এবং আলোচনা চলাকালে বিভিন্ন অভিযানে ২২০ তালেবান যোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
গজনির হামলা তালিবানের শক্তি প্রদর্শনীর একটা হামলা। যাতে কেউ মনে করা না হয় যে, তাদের শান্তি আলোচনায় অংশ নেয়ার অর্থ হলো তাদের শক্তি কমে গেছে এবং ট্রাম্প প্রশাসন শক্তি প্রয়োগে তাদের আলোচনার টেবিলে বসানোর ব্যাপারে সফল হয়েছে। এই হামলা আরও প্রমাণ করে আফগান বাহিনী আসলেই কতটা দুর্বল। কাবুলের কাছাকাছি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ একটা শহরে টিকে থাকার মতো শক্তিও তাদের নেই।
এই হামলা পরবর্তী প্রতিটি আলোচনার টেবিলে এটাকে তারা দরকষাকষির জন্য কাজে লাগাবে। এই হামলা তাই শান্তি আলোচনাকে জটিল করবে না, আলোচনার টেবিলে এটা তালেবানদের বাড়তি শক্তি দেবে।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে প্রথমবারের মতো প্রতিবেশী দেশে সফরে যায় তালেবানদের একটি প্রতিনিধিদল। প্রতিপক্ষের কাছে তালেবানরা পরিস্কার বার্তা দিয়েছে যে, তাদের আঞ্চলিক গ্রহণযোগ্যতাই শুধু বাড়ছে না; বরং রাজনৈতিক শক্তি হিসেবেও তাদের স্বীকৃতি মিলেছে।
আরো তাৎপর্যপূর্ণ হলো, তাসখন্দের সাথে কাবুল ও ওয়াশিংটনের সম্পর্ক উষ্ণ ও সহযোগিতামূলক হওয়ার পরও তালেবানরা উজবেকিস্তান সফর করেছে। আঞ্চলিক হিসাব-নিকাশের কথা বিবেচনা করলে যেখানে তালেবানরা একটা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করছে।
যদি চলমান আলোচনা এবং গজনিতে সাম্প্রতিক হামলা থেকে কোনো কিছু বোঝার থাকে, তাহলে সেটা হলো, তালেবানদের কূটনৈতিক বা সামরিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম যুক্তরাষ্ট্র।
এক বিবৃতিতে, তালেবান প্রধান মোল্লা আখুন্দজাদা মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে সাম্প্রতিক যোগাযোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে ‘অবাস্তব’ প্রস্তাব দেয়ার জন্য ওয়াশিংটনের সমালোচনা করে বলেছেন, এটি কেবল যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করবে।
আফগান তালেবানদের অন্যতম প্রধান দাবি হলো, আফগানিস্তান থেকে বিদেশী সেনাদের প্রত্যাহার করে নেয়া। সেই সাথে, তালেবানরা এটাও বলে এসেছে যে, তারা শান্তি আলোচনায় বসতে প্রস্তুত, কিন্তু সেটা হতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে, আফগান সরকারের সাথে নয়।
কার্যত, গত ২৩ জুলাইয়ের মার্কিন-তালেবান দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের মধ্য দিয়ে তালেবানদের মর্যাদা যুক্তরাষ্ট্রের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। তালেবানরা বহুদিন ধরে এটাই কামনা করে এসেছে। তালেবানরা নিজেদের ‘অপেক্ষমাণ সরকার’ হিসেবে বিবেচনা করে, শুধু একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নয়। তালেবানরা স্পষ্টতই একটা শক্তির জায়গা থেকে কাজ করছে এবং কৌশলের সাথে দরকষাকষি করছে।
আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি আবারো যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছেন। এই সময় এটি করা হয়েছে এবারের ঈদুল আজহা থেকে তিন মাস সময়ের জন্য। এর মধ্যে কাবুল এবং তালেবান উভয়ই আটক কিছু বন্দীকে মুক্তি দিতে সম্মত হয়েছে। গত জুন মাসে রোজার ঈদের ছুটির সময় তিন দিনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল তালেবান।
তালেবানদের ‘আলাপ ও যুদ্ধ’ পদ্ধতিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘নয়-এগারো’র হামলার পর তালেবানকে হটিয়ে ক্ষমতা গ্রহণকারী রাজনৈতিক জোটকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে শুরু করেছে। জোটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করে তালেবানদের সাথে আলোচনা হবে ‘রাজনৈতিক আত্মসমর্পণের নামান্তর’।
এত কিছুর পরও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য স্বস্তির কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না। ১৭ বছর ধরে মার্কিন সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের কোটি কোটি ডলার খরচ করার পরও তালেবান বিদ্রোহীরা কাবুলের ওয়াশিংটনসমর্থিত সরকারকে আঘাত করতে সক্ষম বলে মনে হচ্ছে। শুধু আফগানিস্তানে নয়, এটি যেকোনো পরিমাপে ওয়াশিংটনের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাক্সক্ষার জন্য একটি ঐতিহাসিক পরাজয়।
গত সপ্তাহে তালেবানের দুঃসাহসিক হামলায় মনে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত সরকারি বাহিনী একটি হেরে যাওয়া যুদ্ধে লড়াই করছে। এ দেশের বেশির ভাগ এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এমনকি রাজধানী কাবুল ভারী আক্রমণ অভিযানের মুখে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে।
আফগানিস্তানে প্রায় দুই দশকব্যাপী এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে পড়েছে এর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব। সবশেষে কথিত ‘সর্বশক্তিমান’ মার্কিন শক্তি এখানে নিজের অপরাধ, মূঢ়তা ও অহঙ্কার দ্বারা পরাজয়ের চূড়ান্ত কবরস্থানই তৈরি করবে বলে মনে হচ্ছে।