‘হ্যাশট্যাগ মি-টু’ খুলে দিচ্ছে ভোগবাদী সমাজের মুখোশ

আতাউর রহমান খসরু ।।

বিনোদন জগতে যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলন ‘হ্যাশট্যাগ মিটু’ (#me_too)-এর ঝড় বইছে সোস্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে। হলিউডের পর ‘মিটু’ ঝড়ে কাঁপছে বলিউডও। ক্রমেই তার রেশ ছড়িয়ে পড়ছে চলচ্চিত্র জগতের বাইরে। যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠছে রাজনীতিক, সমাজকর্মী, শিল্পপতি থেকে শুরু করে পত্রিকা সম্পাদকের বিরুদ্ধেও। হ্যাশট্যাগ মিটু মুখোশ খুলে দিচ্ছে সমাজের সব হোমড়া চোমড়াদের।

তবে প্রতিবাদকারী নারী অভিনেত্রীদের পেশা ও জীবনপ্রবাহ নিয়েও প্রশ্ন আছে অনেকের। প্রশ্ন উঠছে- নারীসুলভ জীবনযাপন ও নারীত্বের প্রতি তারা নিজেরাই বা কতোটা শ্রদ্ধাশীল? ইসলামের শালীন-সুন্দর নারী জীবনের বিপরীতে যে অবাধ জীবনকে বেছে নিয়েছে তারা তারই অসারতা প্রমাণ করছে আজকের এ আন্দোলন। এ আন্দোলনে খসে পড়ছে তাদের ভোগবাদী সমাজের বর্ণিল মুখোশ।

গত শতাব্দীর শেষদিকে ১৯৯৭ সালে কৃষ্ণাঙ্গ সমাজকর্মী টারানা বার্ক হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলনের সূচনা করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ওয়ার্ডপ্রেসে। ২০০৬ সালে তিনি নারীর প্রতি যৌন নিপীড়নের নাম দেন ‘মি টু’ – অর্থাৎ আমিও যৌন হয়রানির শিকার। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই ছিলো সেই আন্দোলনের প্রতিপাদ্য বিষয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি।

২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকার গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড হলিউড-এর সিনেমা প্রযোজক হার্ভে উইনস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনেন অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো। তার প্রতিবাদী উচ্চারণের পর প্রযোজক হার্ভের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেন আরও অনেকে। তাদের প্রতিবাদের ভাষা ছিলো #me_too। মাত্র এক মাসের মধ্যেই মিটু আন্দোলনের পক্ষে এবং যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে মিছিল করে হলিউডের নারী কর্মীরা।

অনেকেই সরব, তাতে কি নারী নিপীড়নের সুরাহা হবে?

সম্প্রতি মিটু আন্দোলন শুরু হয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি বলিউডে। অশ্লীলতার মোড়কে অভিনয় করে এক সময়কার সাড়া জাগানো অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত সর্বপ্রথম যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনেন অভিনেতা নানা পাটেকারের বিরুদ্ধে। এখন তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন অনেক অভিনেতা ও অভিনেত্রী। একের পর এক অভিযোগ উঠছে লেখক, গায়ক, পরিচালক, প্রযোজক, সহ-অভিনেতাসহ বিনোদনের জগতের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। এতোদিনের চেপে রাখা অন্ধকার হঠাৎ করেই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। মানুষ বুঝছে রূপালী পর্দার অভিনেতাদের ভেতর বাস করে একেকজন খলনায়ক, মুখোশের আড়াল আছে অনেকের কুৎসিত রূপ।

বিষয়টি নিয়ে আমরা কথা বলি সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকজন চিন্তাশীল তরুণ আলেমের সঙ্গে। তাদের একজন মুফতি ইউসুফ সুলতান। চলচ্চিত্র জগতের ভেতরের যে রূপ আমাদের সামনে বেরিয়ে আসছে তা পুরো সমাজব্যবস্থারই একটি খণ্ডচিত্র বলে মনে করেন তরুণ আলেম ও আইটি স্পেশালিস্ট মুফতি ইউসুফ সুলতান। তিনি বলেন, ‘শুধু বিনোদন জগত নয়; বরং পুরো সমাজব্যবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করে হ্যাশট্যাগ মিটু। পশ্চিমা দেশে নারীরা যে প্রতিবাদ শুরু করেছে তার ভেতর আপনি সমাজের সব শ্রেণির পুরুষকেই দেখতে পাবেন।

আজ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী নিপীড়নের জন্য দায়ী কে? এর দায় কি শুধু পুরুষের নাকি নারীরও কিছু দায় রয়েছে? একজন নারীর যে শালীন ও সভ্য জীবনযাপন করা উচিত ছিল তা কি তারা করছে? নাকি অশ্লীলতার মাদক ছড়িয়ে সমাজের অসংখ্য নারীকে বল্গাহীন জীবনের পথে প্রলুব্ধ করছে? তাদের অনিয়ন্ত্রিত উচ্ছৃংখল জীবন যে তাদের বিপদকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে তা বুঝতে পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন হয় না।’

মুফতি ইউসুফ সুলতান

মুফতি ইউসুফ সুলতান মনে করেন, যৌন নিপীড়নে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে নারীর দায়ও খুব কম নয়। তিনি বলেন, ‘এক কথায় কারণ বললে বলতে হবে, সমাজের সর্বস্তরে ইসলাম উপেক্ষিত হওয়াই নারীর অনিরাপত্তার কারণ। আজ নারী নারীর জায়গা থেকে, পুরুষ পুরুষের জায়গা থেকে, পরিবার পরিবারের জায়গা থেকে, সমাজ সমাজের জায়গা থেকে এবং রাষ্ট্র রাষ্ট্রের জায়গা থেকে ইসলাম উপেক্ষা করেই চলছে। ফলে পুরো জীবনব্যবস্থা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য বৈরী হয়ে উঠেছে। নারীর জন্য তো বটেই।’

তবে তিনি মনে করেন, নারীর প্রতিবাদী হয়ে ওঠা ইতিবাচক। এ প্রতিবাদের কারণেও মানুষ বুঝতে পারবে ইসলামের বিপরীতে তারা কেমন জীবনব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছে। ইসলাম বলেছে, নারী-পুরুষের নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা আবশ্যক। তাদের ঘনিষ্ঠতা বিপজ্জনক। আজকের আন্দোলন সেটাই প্রমাণ করছে।

মুফতি ইউসুফ সুলতান এর সাথে যোগ করেন নারীর বাণিজ্যিক ব্যবহার, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, মাদক-পর্নোর সহজপ্রাপ্তি ইত্যাদি বিষয়ও।

রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছারও অভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করেন এ আলেম ও গবেষক। তিনি দাবি করেন, সরকার চাইলে অশ্লীলতার প্রবাহগুলো খুব সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু অজানা কারণে তা করা হয় না।

ভোগবাদী সমাজব্যবস্থার মুখোশ খুলে গেছে এই মিটু প্রহসনে

হ্যাশট্যাগ মিটু জীবন আচরণে আরও সংযত হওয়ারই বার্তা দেয় বলে মনে করেন আরেক তরুণ আলেম মনযূরুল হক। তিনি বলেন, এর কারণ, অসংযত জীবনই মানুষকে ধীরে ধীরে পাপের গভীর খাঁদে নিক্ষেপ করে।

তিনি আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গড়ে ওঠা এ আন্দোলন আমাদের সেসব মানুষকে চিনতে সাহায্য করে যারা প্রগতির নামে অশালীন ও অসংযত জীবনকে উস্কে দেয়। আপনি দেখবেন, আজ যাদের বিরুদ্ধে নারীর প্রতি অসম্মান করার অভিযোগ উঠছে তাদের অধিকাংশই কথিত প্রগতির মশালধারী। তারা নানান প্রলোভনে নারীকে ঘরছাড়া করছে, অনিরাপদ পরিবেশে টেনে আনছে। তারপর সুযোগ বুঝে হামলে পড়ছে তাদের উপর। তাদের দ্বিচারিতা এখন মানুষের সামনে উন্মোচিত হল।

তিনি এর বিপরীত একটি চিত্রও তুলে ধরেন। বলেন, যেসব অভিনেত্রী আজ যৌন হেনস্থার অভিযোগ করছেন তাদের অনেকের প্রোফাইল ঘাটলে দেখা যাবে অনেকেই ক্যারিয়ার, খ্যাতি, মিডিয়া কভারেজ ইত্যাদির জন্য পুরুষ সহকর্মীকে অশালীন জীবনে যেতে নানা সময়ে প্রলুব্ধ করেছে। আবার অভ্যস্ত পুরুষরা যখন জোর করছে তখনই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তুলছে। ইসলাম স্বেচ্ছা ও অনিচ্ছায় সব ধরনের অবৈধ যৌনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বলে। আর সেটাই হল আসল সমাধান।

মনযূরুল হক

মনযূরুল হক বেশ খেদ নিয়ে বলেন, আজ যে জীবন নারীর জীবন ও সম্ভ্রমকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে তার বিরুদ্ধে যখন বিবেকবান সভ্য রুচিশীল ব্যক্তিরা কথা বলেছেন, তখন তাদেরকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে গালি দেয়া হয়েছে, তাদের বলা হয়েছে প্রান্তিক চিন্তার অধিকারী, নারীর স্বাধীনতা ও উন্নয়নের বিরোধী। অথচ আজ নারীই সেসব নারীবন্ধুদের মুখোশ খুলে দিচ্ছে।

সমাজব্যবস্থার প্রতিটি অবস্থানে ছড়িয়ে পড়া এ রোগের সমাধানে দুই তরুণ আলেমই গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। মুফতি ইউসুফ সুলতান বলেছেন, আমাদের উচিত ইসলামের পথে ফিরে আসা। ইসলামের অনুপম জীবনাদর্শ মেনে চলা। নারী বা পুরুষ, সমাজ বা রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে ইসলাম আমাদের যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা যথাযথভাবে পালন করাই এ সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম পথ।

তিনি আরও বলেন, সার্বিক সমস্যার সমাধানে এবং ইসলামি জীবনব্যবস্থায় ফিরে যেতে একজন আদর্শ নেতার কোনো বিকল্প নেই। সঠিক নেতৃত্ব মানুষকে সঠিক পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করে। সঠিক গন্তব্যে নিয়ে যায়।

মাওলানা মনযূরুল হক বলেন, হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলনের পর আমাদের প্রধান দায়িত্ব হবে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করা। তাদেরকে অনিয়ন্ত্রিত জীবনের পরিণতি সম্পর্কে সচেতন করা। তথাকথিত প্রগতিশীল মুখোশপরা চেহারা মানুষকে দেখিয়ে ভোগবাদী জীবনব্যবস্থা থেকে ইসলামি জীবনব্যবস্থার প্রতি আগ্রহী করে তোলাই হবে সর্বোত্তম পন্থা।

পূর্ববর্তি সংবাদ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ উক্তিটি ইসলামবিরোধী : আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী
পরবর্তি সংবাদ‘উর্দু সম্মিলনগুলোতে লেখকদের সঙ্গে পরিচয় গড়ে ওঠে’ -ড. গোলাম রব্বানী