ভারতে মুসলিম নিপীড়ন উস্কে দিচ্ছে বিজেপি সরকার : সালমান খুরশিদ

সালমান খুরশিদ। সর্বভারতীয় কংগ্রেসের একজন কেন্দ্রীয় নেতা। তিনি কংগ্রেস সরকারের সময় পররাষ্ট্র, আইন, সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপালন করেছেন। ৬৫ বছরের বর্ষীয়ান এ রাজনীতিবিদ উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতিও ছিলেন। ভারতের সবচেয়ে জনবহুল এ প্রদেশ থেকেই জাতীয় রাজনীতিতে উঠে এসেছে একাধিক মুসলিম নেতৃত্ব।
সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেট বোর্ডের দায়ের করা একটি মামলার শুনানিতে অংশ নিতে তিনি একজন আইনজীবী হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আসেন। তার আরব আমিরাত সফরের সময় ভারতীয় মুসলিমদের উপর ‘গালফ নিউজে’ একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি ভিন্নমতযোগ্য কিছু বিষয়ের সাথে ভারতীয় রাজনীতিতে মুসলিম বিদ্বেষের গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ দিয়েছেন ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি ইসলাম টাইমস-এর পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন আতাউর রহমান খসরু

ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলিম রয়েছে। বর্তমানে তারা সমাজের প্রান্তিক সীমায় বাস করছে। তাদের এই নিরাশা সম্পর্কে কিছু বলবেন?

-আমি মনে করি আপনি যা বলছেন তা যথার্থ নয়। এটাকে নিরাশা বলা যায় না। তবে আমি স্বীকার করি, তারা স্পষ্টতই ভিন্ন আচরণের মুখোমুখি হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে ইউপিএ সরকার সাচার কমিটির মাধ্যমে কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলো –যা ছিলো চমৎকার ও সুদূরপ্রসারী। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার সুফল দেখার আগেই সরকারের সময় শেষ হয়ে যায়। কংগ্রেস বিরোধী দলগুলো সরকার গঠন করার পর তা বাতিল করা হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর বিষয় উত্থাপন করে। তাদের কৌশলের কাছে কংগ্রেস হেরে যায়।

তাহলে কি মুসলমান ভারতের নতুন অস্পৃশ্য বা আজকের দলিত?

-দেখেন! ভারতীয় সমাজে এখনও অনেক শক্তিশালী ইতিবাচক চিন্তা ও উল্লেখ করার মতো উদারতা রয়েছে। উদার মানুষও আমাদের সমাজে আছে যাদের সবাই মুসলিম না। ইন্ডিয়ায় যারা মুসলমানের অধিকার নিয়ে জোর আন্দোলন করছে, অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে তাদের সবাই মুসলিম নয়।
তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো আপনি মুসলমানদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যাপারে যতো বেশি সোচ্চার হবেন পরিস্থিতি ততোই তাদের হাতে চলে যাবে -যারা মুসলিমবিদ্বেষকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সুতরাং আত্মরক্ষার জন্য মুসলিমদের আরও বাস্তববাদী হতে হবে, আরও বুঝে শুনে পা বাড়াতে হবে।
নিরাপত্তার কথাও বলতে হবে একজন সাধারণ মানুষ ও নাগরিক হিসেবে। সমাজের অন্যান্য দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ যেভাবে নিরাপত্তার আবেদন করে। স্বতন্ত্র মুসলিম জাতি বা সংখ্যালঘু হিসেবে নয়।

Image result for salman khurshid

আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন ‘মুসলিম’ শব্দটাই ভারতে অগ্রহণযোগ্য ও বাজে শব্দ?

-হ্যা, বিজেপি সরকার এ কাজটাই করেছে। কংগ্রেসের আপত্তি সত্ত্বেও বিজেপি রাজনীতিতে ‘মুসলিম’ শব্দটিকে মন্দভাবে উপস্থাপন শুরু করেছে। বিষয়টি অন্যায়। তবে একই সঙ্গে তা সত্যিকার অর্থে ভারতীয়দের মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করছে। তাদের অধিকার রক্ষায় আন্তরিকতা, নিবেদন ও অঙ্গীকার বাড়াচ্ছে ক্ষমতাসীনদের মুসলিম বিদ্বেষ।
আমরা বিজেপিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না এবং সেটা সম্ভবও নয়। আমরা পারতাম যদি আমরা সরকারে থাকতে সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষায় কার্যকর কমিশন গঠন করতে পারতাম। সেটা আমরা পারিনি। কারণ, ভারতীয় জনগণের বেশির ভাগই মনে করে অধিকার রক্ষার বিষয়টি শিক্ষা ও চাকরির মতো বিষয়ে সীমাবদ্ধ। অথচ বর্তমানে অন্য নাগরিকদের তুলনায় মুসলমানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিরাপত্তা।
উত্তরপ্রদেশে পুলিশ অনেক মুসলিমকে ক্রসফায়ারে হত্যা করেছে। অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠিও ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছে। ভারতে এখন দাম্ভিকতা ও আইন অমান্যে ‘ডোন্টকেয়ার’ ভাব তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বড় আঘাত মুসলমানের উপর আসছে, কিন্তু অন্যদের ব্যাপারেও আঘাতগুলো মিথ্যে না।

আপনি কি বলছেন, ভূক্তভোগী হিসেবে মুসলিমরা তাদের জাতিগত পরিচয় দেয়া বন্ধ করুক?

-হ্যা, ঠিক তাই। মুসলমানরা কেন শুধু মুসলমানের কথা বলে গণরোষের শিকার হবে? একজন দলিত বা অন্য কোনো সাধারণ মানুষ যখন নির্যাতিত হয় তখন একইভাবে কেন মুসলমান তার প্রতিবাদ করবে না? অন্যান্য মানুষের ব্যাপারে মুসলমানকে প্রতিবাদী হতে হবে। এতে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে; সমাজের সবশ্রেণির সাথে সেতুবন্ধন তৈরি হবে। কিন্তু দেখা যায়, মুসলিম সমাজ শুধু তখনই প্রতিবাদ করে যখন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সমস্যা তৈরি হয়। আমাদের উচিৎ বেনারাস (হিন্দু) বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু হলেও তার প্রতিবাদ করা। একজন উদার মানুষ শুধু আলীগড় ইস্যুতে চিন্তিত হবেন না …

আপনি কি একমত যে, গণপিটুনি ও ‘লাভ জিহাদ’ একই সূত্রে গাঁথা?

-আমি মনে করি না তারা সংঘবদ্ধ। যা কিছু হচ্ছে তার সব কিছু সংঘবদ্ধ, পরিকল্পিত অথবা কোনো নিয়ম মাফিক হচ্ছে তা বলা যায় না। তবে তাদের মধ্যে একটা সাধারণ চিন্তা কাজ করে। তাহলো, একাজে রাষ্ট্র অসন্তুষ্ট নয়। যখন মানুষের মধ্যে এ ধরনের চিন্তা কাজ করে তখন আইন লঙ্ঘিত হওয়া এবং ধ্বংস ছড়িয়ে পড়া অপরিহার্য হয়ে যায়।
যখন কোনো সন্ত্রাসী সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়, যখন জনগণকে রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধ করে এবং সাধারণভাবে প্রশাসন তার অনুমোদন দেয় তখন তা ঠেকানো যায় না। জনগণ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়।
আমরা এখনও সরকারকে এসব সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখিনি। এমনকি বহুল আলোচিত পেহলু খান ও আখলাক ইস্যুতেও সরকার নীরব। এতো বছরে একটি চার্জশিট পর্যন্ত দাখিল করা হয়নি।
এসব কাজের মাধ্যমে সরকার জনগণকে এ বার্তাই দিতে চাচ্ছে যে ‘তোমরা যা করছো ভালো করছো।’ এটা গ্রহণযোগ্য নয়। জনগণের চাপে পড়ে প্রধানমন্ত্রী কখনো কখনো এর সমালোচনা করেছেন বটে; কিন্তু আমি কখনো প্রধানমন্ত্রীকে নাগরিকদের জীবনরক্ষায় ততোটা সক্রিয় হতে দেখিনি তিনি রাস্তা পরিস্কার, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার বিষয়ে তিনি যতোটা সক্রিয়।

মুসলিম ইস্যুতে আমরা ভারতে দুই ধরনের লোক দেখতে পাই। এক. আসাদুদ্দিন ওয়াইসি –যারা কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। দুই. সালমান খুরশিদ –যারা জনগণের মূল সমস্যা বোঝার চেষ্টা করছে।

-ওয়াইসির একটি সমস্যা আছে। আমার সেটা নেই। মুসলিম সমাজের যোগ্য প্রতিনিধিত্ব করবে এমন যে কারো জন্য আমি আমার সিট, আমার অবস্থান, আমার এলাকা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতে রাজি আছি। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি অবশ্যই তাদের স্বাগত জানাবো। কিন্তু তারা সেটা পারবে না। তারা বলবে, এই লোক কি বলছে আমাদের বুঝে আসছে না। অথচ তাদের বলা দরকার ছিলো আমি এই লোককে ভালোই জানি।
এই সমস্যার সঙ্গেও আমাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে। এই যুদ্ধটা অনেক বেশি কঠিন গণধোলাই বা গণরোষের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধের চেয়ে। কারণ, তাদের নৈতিক স্খলন প্রকাশ্য। আমরা তাদের প্রতিহত করতে পারি বা না পারি তাদের নৈতিক স্খলন তো পরিস্কার। আমরা নেতাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে বুঝি তাদের নীতি-নৈতিকতার জায়গাটা পরিস্কার নয়।

https://static.kashmirobserver.in/assets/container/styles/large/public/media/article-images/2018/17/salman-khurshid.jpg

মুসলিম হিসেবে ভারতীয় মুসলিদের প্রতি আপনি কি বার্তা পৌঁছাতে চান?

-মুসলিম সমাজের প্রতি আমার বার্তা হলো, যদি আপনার ঈমান ঠিক থাকে তবে অন্য সমস্যাগুলো মৌলিক কোনো সমস্যা না। আর যদি ঈমান ঠিক না থাকে তবে আপনি শুধু নামেই মুসলিম। নৈতিকতা ও বিশ্বাসই আপনার ধ্রুব সহচর।
আল্লাহ আমাদের বলেননি, তুমি যেহেতু আমাকে বিশ্বাস কর তোমার আর কিছু করার নেই, নিজের উন্নয়নে কঠোর পরিশ্রম করবে না, তুমি নিজেকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করবে না, তুমি তোমার মাসল (মাংসপেশী) তৈরি করবে না, তুমি তোমার বিরুদ্ধে করা অবিচার রুখে দাঁড়াবে না, তুমি আইনি লড়াইয়ে যাবে না। আমার মনে হয়, স্রষ্টার ইচ্ছে এমন নয়।
আমার মনে হয়, স্রষ্টার ইচ্ছে হলো আমরা এগুলো করবো। তিনি চান আমরা যেন নিজেকে সাজিয়ে তুলি, আমরা যেন নিজেকে প্রস্তুত করি।যাতে যুদ্ধের ময়দানে আমাদের কোনো দুর্বলতা প্রকাশ না পায়। আমরা যদি নিজেদেরটা করি তবে তিনি আমাদের রক্ষা করবেন। কথায় আছে ‘হিম্মতে মর্দা মদদে খোদা।’
আমাদের যদি যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় তবে লড়াইয়ের সাহস হারাবো না এবং আমার মুসলিম হিসেবে নিপড়ীতও হবো না।

পূর্ববর্তি সংবাদসোমবার ঢাকার মিরপুরে ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না
পরবর্তি সংবাদআজান-নামাজের সময় বন্ধ থাকবে পূজার বাদ্য-বাজনা : ডিএমপি