জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট : অসম ঐক্যে সমতার সূত্র!

আবুল কাসেম আদিল  ।।  

শেষ পর্যন্ত ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠিত হলো। বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপির মির্জা ফখরুলা ক্ষুদ্রতর দলের নেতা কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একমত হলেন। স্পষ্টত তাঁরা দলের চেয়ে ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিলেন। আমরা যদি আপাত অসম ঐক্যফ্রন্টের শুরুটা খেয়াল করি, তাহলে গতকালের চূড়ান্ত ঘোষণার সঙ্গে তার বেশ পার্থক্য দেখতে পাব। এর মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাব অসম ঐক্যে সমতার সূত্রও।

১. শুরুতে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা খালেদা জিয়ার নাম মুখে নিতে আগ্রহী ছিলেন না। তার নাম ও দায় নিতে লজ্জা পাচ্ছিলেন মনে হয়। সকল রাজবন্দীর মুক্তি, সকল রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলা প্রত্যাহার, নতুন করে কারো বিরুদ্ধে মামলা না দেওয়া, গ্রেফতার না করা— এসব ঐক্যফ্রন্টের দাবিসমূহের মধ্যে ছিল। এসব দাবিতে পরোক্ষভাবে খালেদা জিয়ার মামলা ও গ্রেফতারের বিষয় থাকলেও সরাসরি খালেদা জিয়ার কথা বলতে তাঁরা রাজি ছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্যের নেতারা সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। এখন তাঁরা খোলাখুলি খালেদা জিয়ার মুক্তি চাইছেন। খালেদা জিয়ার মুক্তি চাওয়া ছাড়া বিএনপিকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গঠিত হতে পারত না। কারণ সদ্যগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সবচে বড় দল। জাতীয় ঐক্যের প্রধান ড. কামাল হোসেনও যদি নির্বাচিত হতে চান, বাংলাদেশের তিনশ সংসদীয় আসনের যেখান থেকেই চান— বিএনপির সমর্থকদের ভোটে নির্বাচিত হবেন। সম্ভবত বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়েই ভোটে লড়বেন। অথবা যে প্রতীকেই লড়েন, বিএনপির ভোট ছাড়া জেতার সম্ভাবনা নেই। যে দলের ভোটারদের ভোটে জিতে এমপি হতে চান সেই দলের প্রধান নেতার নাম মুখে নিতেই যদি লজ্জা পান, তাহলে চলবে কেমনে! সুতরাং মনে করতে পারি যে, ড. কামাল হোসেনসহ ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন বিএনপির সঙ্গে অন্য ক্ষুদ্র দলগুলোর অসম ঐক্যে প্রধান সমতার সূত্র খালেদা জিয়া। কাজেই তাঁরা খালেদা জিয়ার মুক্তি চাইতে রাজি হয়েছেন। সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হলে, পরিস্থিতি বুঝে এঁরা হয়ত তারেক রহমানের পক্ষেও কথা বলবেন।

২. জামায়াত ও ইসলামী দলগুলোর বিষয়ে কামাল-মান্নাদের ছুঁৎমার্গ আছে। একারণে জাতীয় ঐক্যে অন্যতম বিতর্কের বিষয় ছিল জামায়াত। এই ফ্রন্টের দলগুলোর সঙ্গে সকল ইসলামী দলের বৈসাদৃশ্য থাকলেও তাদের বড় আপত্তি ছিল জামায়াত নিয়ে। জামায়াতের সঙ্গে এই দলগুলোর আদর্শিক বিরোধ আছে, অথচ ভোটের মাঠে জামায়াতের সমর্থক বেশি। একদিকে স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে ঐক্যের তকমা থেকে গা বাঁচিয়ে চলা, অন্যদিকে জামায়াতের ভোট নিজেদের বাক্সে ভরা— শেষমেশ এই দোটানার একটা সুরাহা হলো। সুরাহাটা হলো এভাবে— গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, জাসদ (রব) এই দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির ঐক্য হবে। বিএনপির সঙ্গে আলাদা করে আর কোন কোন দলের ঐক্য আছে, এটি সদ্যগঠিত ঐক্যফ্রন্টের দেখার বিষয় নয়। কিন্তু বিকল্প ধারা তথা বি চৌধুরী ও মাহী বি চৌধুরীর প্রস্তাব ছিল ভিন্ন। তাঁরা চাইছিলেন শুধু বিএনপির সঙ্গে ঐক্য হবে না, জামায়াত ছাড়া বিশদলীয় জোটভুক্ত সকল দলের সঙ্গে অভিন্ন ঐক্য। বিএনপিনেতারা শেষ পর্যন্ত জামায়াত ছাড়া ঐক্য করতে রাজি হন নি। শেষমেশ এভাবে সুরাহা হলো— গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, জাসদ (রব) এই দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির ঐক্য হবে। বিএনপির সঙ্গে অন্য দলগুলোর ঐক্য আছে কি না, ঐক্যফ্রন্টের দেখার বিষয় নয়। জামায়াত বিষয়ে ছুঁৎমার্গ জিইয়ে রেখেই অচ্ছুৎ দলটির ভোট নিজেদের বাক্সে পাওয়ার উত্তম তরিকা আবিষ্কার করা হলো। রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার প্রবণতায় এই বিবেচনাটি হয়তো তাদের সামনে এসেছে।

৩. ঐক্যফ্রন্ট গঠনে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারসাম্যের প্রশ্ন। বিএনপি বড় দল। সেই তুলনায় অন্য দলগুলো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। ক্ষমতায় গেলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দলগুলোর বড় বড় নেতাদের মর্যাদা কী হবে— এই প্রশ্ন সামনে চলে এসেছিল। বিশেষতঃ বি চৌধুরীরা বিষয়টা নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন। বি চৌধুরী বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুল ক্রমে ড. কামালের চেয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে গুরুত্বপূর্ণ উঠছিলেন।’ ভারসাম্য রক্ষার্থে বিকল্প ধারা প্রস্তাব দিয়েছে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিশদল ১৫০ ও সদ্যগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্য দলগুলোকে ১৫০ আসন দিতে হবে। এতে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষিত হবে। এতে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। কারণ বিএনপি এককভাবে দুই তৃতীয়াংশ আসনের অধিকারী থাকবে না। এটা আশ্চর্যের যে, তাঁরা বিএনপির ভোটে ক্ষমতায় যেতে আগ্রহী, কিন্তু বড় দল হিসেবে বিএনপিকে এক ছটাক বেশি মর্যাদা দিতেও রাজি নন। অসম দলের নেতা হয়ে সমমর্যাদা চাইছেন, এটার সুরাহা হয় নি। এজন্য বি চৌধুরীকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করতে হয়েছে। সুতরাং বলা যায়, বি চৌধুরীদের কারণে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সূচনাটা সর্বাঙ্গসুন্দরভাবে হতে পারল না। বৃহৎ বিএনপির সঙ্গে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দলগুলোর অসম ঐক্যে অন্যতম সমতার সূত্র হলো— কিছুটা অসমতা মেনে নেওয়া। যাঁরা মানতে প্রস্তুত ছিলেন, তাঁরা ঐক্যপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছেন। যাঁরা মানতে পারেন নি, তাঁরা ছিটকে পড়েছেন। আবার যদি মানতে প্রস্তুত হন, অহঙ্কার ছাড়তে পারেন— তাহলে ঐক্যপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবেন। যুক্তফ্রন্টের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না ও আসম আ. রবের কথায় বোঝা গেল, তাঁরা বি চৌধুরীর প্রত্যাবর্তনের সুযোগ জিইয়ে রাখতে আগ্রহী। আসম রব বলেছেন, ‘অসুস্থতা বা কোনো কারণে হয়ত বদরুদ্দোজা চৌধুরী উপস্থিত হতে পারেন নি। আমরা ধরে নিচ্ছি তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন।’ মাহমুদুর রহমান মান্না মাহী বি চৌধুরীর সঙ্গে ফোনে বলেছেন, তিনি বসে  কথা বলতে আগ্রহী।

তবে দেখার বিষয় হচ্ছে বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন ২০ দল থাকার পরও এ ধরনের বড় মুখের ছোট দলের সঙ্গে জোট করার কোনো সুফল শেষ পর্যন্ত তারা পাবে কি না! নাকি এরই মধ্যে ড. কামাল আর বি চৌধুরীর দ্বিমুখী যাত্রার মতো নতুন নতুন হোঁচটে বিএনপির সামনে হতাশা কিংবা জটিলতার পাহাড় এসে দাঁড়াবে? এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য হয়তো আমাদের নির্বাচনের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

পূর্ববর্তি সংবাদফিলিপাইনের ম্যানিলায় দাওয়াতের কাজের সম্ভাবনা অনেক
পরবর্তি সংবাদসৌদি জোটের বিমান হামলায় ইয়েমেনে ১৭ জনের প্রাণহানি