হিন্দু-মুসলিম বন্ধুত্বের ঐতিহ্যেও রক্ষা পাচ্ছে না মিও মুসলিমরা

হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ঐতিহ্যও নিশংসতার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না ভারতের হারিয়ানা প্রদেশের মেওয়াত জেলার মিও মুসলিমরা। বরং ভারতে গত তিন-চার বছর ধরে গোরক্ষার নামে যে সব মানুষ পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে, তার অনেকগুলোতেই হামলার শিকার ছিলো তারা।

শত শত বছর ধরে হিন্দুদের পাশে থেকেছে এই মিও-রা। অনন্য সম্প্রীতির ইতিহাস রয়েছে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে। স্থানীয় সংস্কৃতিতেও পড়েছে তার প্রভাব। মেওয়াতের একটি লোক সঙ্গীতে বলা হয়েছে,

‘বাপুজি যব ঘসেরা আয়োঁ, হিন্দু-মুসলিম ইয়ানে সব সামে যায়োঁ।’

তুমি যখন ঘসেরায় আসবে, হিন্দু-মুসলিম সবার সাথে মিশে যাবে।

কিন্তু এখন হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির এ দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করেছে। প্রতিবেশী হিন্দুদের দ্বারা বারবার আক্রান্ত হচ্ছে তারা। আর এজন্য তারা বিজেপি সরকারের হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে দায়ী মনে করছে।

মেওয়াতের মানুষকে প্রায় দুঃখ করে বলতে শোনা যায়, বিজেপি সরকার যখন থেকে ক্ষমতায় এসেছে তখন থেকেই এই দশা – তারা মুখে বলে এক, আর করে এক।

আশ মুহাম্মদ, চাঁদ-খানরা বলছিলেন, ‘এই তল্লাটে কেউ কোনওদিন জাতধর্ম নিয়ে ভাবেনি, অথচ এখন সর্বত্র ভয় আর আতঙ্ক, গরু-মোষ আনতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণটা না-যায়!’

মেওয়াট লাগোয়া নূহ জেলা সদরে হাজী সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘আমাদের চিরকালই হিন্দুদের সঙ্গে খুব ভাব। মিওদের রাজা হাসান খান মেওয়াতি রাজপুত রানা সাঙ্গার সাথে মিলে বাবরের বিরুদ্ধে পর্যন্ত যুদ্ধ করেছিলেন। মিওরা কোনওদিন মুঘল শাসন পর্যন্ত মানতে পারেনি, তারা ছিল চিরবিদ্রোহী।’

গরু-মোষ যেহেতু তাদের আয়ের প্রধান উৎস, তাই হিন্দুদের মতোই অনেক মিও গোমাংস ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেন না। কিন্তু যে মোষের দুধ দুইয়ে বা মোষকে দিয়ে হাল টানিয়ে তাদের পেট চলে – আশেপাশের গোরক্ষা বাহিনী সেগুলো বাঁচানোর নামেই ইদানীং রাস্তাঘাটে মিওদের মারধর শুরু করেছে।

গোরক্ষার নামে চলমান সহিংসতা মিওদের জীবন-জীবিকার জন্যও হুমকি হয়ে উঠছে ক্রমেই। কারণ শত শত বছর ধরে গরুমোষ পালন করেই এই মানুষগুলোর দিন কেটেছে। কিন্তু আজ সেগুলোই তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে, কিংবা সারাক্ষণ তাদের তটস্থ হয়ে থাকতে হচ্ছে। অনেকে তো বাপ-দাদার পেশাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।‘

স্থানীয় মুসলিমরা জানিয়েছে, তাদের বহুদিনের প্রতিবেশীরাই আজ গোরক্ষার নামে পুলিশের কাছে খবর দিচ্ছে, পুলিশের সঙ্গে মিলে মুসলিমদের ওপর জুলুম করছে।

ঠিক দেড় বছর আগে রোজার মাসের আগে রাজস্থান থেকে দুধেল গাই নিয়ে আসার সময় এই জুলুমের নির্মম শিকার হয়েছিলেন নূহ-র জয়সিংপুর গ্রামের পহেলু খান। হাইরোডে তাদের গরু-বোঝাই গাড়ি আটকে পহেলুকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়।

পহেলুর ছেলে ইরশাদ তাদের বাড়ির দাওয়ায় বসে বলেছিলেন, ‘আমরা কিন্তু গরু পাচার করছিলাম না। গাইদুটো সদ্য বিইয়েছিল, দুটোর পেটেই দশ-বারো লিটার করে দুধ ছিল।’

সে আরও বলে, ‘জয়পুরের সরকারি মেলা থেকে এক-একটা পঁয়তাল্লিশ হাজার রুপিতে কিনেছিলাম, ওগুলো কি আমরা কসাইখানায় ছহাজারে বেচতে যাব না কি? সেই গরু কেনার রশিদ পর্যন্ত ছিল, কিন্তু কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করেনি। ওদের একটাই কথা ছিল, এরা মুসলমান – মোল্লাগুলোকে মারো ।‘

পহেলু খানের বিধবা স্ত্রী জেবুনার শোক জমে জমে এখন পাথর। খানিকটা নিস্পৃহ ভঙ্গীতেই তিনি বলেন, ‘মোদীই তো সব কিছু করাচ্ছেন। তো উনি চাপ না-দিলে আমরা বিচার পাব কোত্থেকে?’

‘জানেন, আমার স্বামী চলে যাওয়ার পর দেড় বছর হয়ে গেল – এত হইচই, এত খবরের কাগজের লোক – থানার একটা চৌকিদার পর্যন্ত কখনও আমাদের বাড়িতে খোঁজ নিতে আসেনি।’

যে মিও মুসলিমরা আজও রাম খান, লক্ষণ খান, শঙ্কর খানের মতো হিন্দুঘেঁষা নাম নিয়ে চলেন, তারা যেন আসলে কিছুতেই ঠাহর করতে পারছেন না এত দিনের পড়শি আর বন্ধুরা কীভাবে হঠাৎ তাদের ঘাতক হয়ে উঠল?

তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা

পূর্ববর্তি সংবাদজীবনস্মৃতি : বাইরে বৃষ্টির ধোঁয়া
পরবর্তি সংবাদজীবিত খাশোগির চেয়ে নিহত খাশোগি সৌদি সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ