জীবনস্মৃতি : বাইরে বৃষ্টির ধোঁয়া

সালিম হাসান ।।

সকালে কায়দা সিপারার সবক দেয়ার সময় আনমন চোখ পূবদিকের জানালা দিয়ে বাইরে ছুটে যায়। খোলা আঙিনার পর খড়ির ঘর। তার ভেতর নারকেলের শুকনো ডাঁটা আর সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে তৈরি তার খেলনাপাতির দোকান… । পাঠ শুদ্ধ না হলে আব্বার মার আর বকুনি খায়। তবুও পড়ার সময় মন উচাটন বড়! বড়ঘরের পূবদিকের দরজার পর নিচু পাচিলঘেরা ছোট মাঠ। উত্তর দক্ষিণে আকাশছোঁয়া দুদুটোসহ পাচিল ঘেঁষে গোটা পাঁচছয় নারকেল গাছ, একদিকে লিচুগাছ আর মাঠের দক্ষিণপূর্ব কোণে মস্ত একটা আমগাছ। অর্ধশত বছরকার প্রাচীন গাছটার বাঁকলে এখানে ওখানে বাদামি রঙের খাঁচকাটা খোসাসমেত অসমতল আগাছায় ভরে আছে। মাঠটার মাঝামাঝি উত্তর দিকের লিচুগাছ আড়াল করা দেয়াল লাগোয়া তল্লাবেড়া আর টিনের ছাউনির আয়তকার একটা লাকড়ির ঘর। ওরা বলে খড়ির ঘর। দশ বাই পনেরো সাইজের ঘরটার দক্ষিণ বেড়ার মাঝখান ঘেঁষে স্লেভ বসানো দুইহাত দুইহাত বর্গাকার বেড়ার ছোট্ট একটা শৌচালয় বানানো হয়েছে কদিন আগে। পূবপাশের দোকানে ঘরের ভাড়াটের জন্য।

ফজরের নামাজ পড়ে আব্বা সাধারণত কুরআন তিলাওয়াতের পর বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে গোল টুলটার ওপর ঢাউস সাইজের একেকটা কিতাব খুলে বসে কিছুক্ষণ নিমগ্ন থাকেন। তারপর সবার কুরআন ও আমপারার সবক নেন। আজ এখনো পড়া নেননি।

শরীরটা ক্লান্ত, তাই একটু বিশ্রামের পর বাইরের বারান্দায় পাতা চৌকিতে বসে অজিফা পড়ছেন আর তজবিহ’র দানা সরাচ্ছেন। নাসিরাবাদ হাই মাদ্রাসায়, পরে গত চল্লিশের দশকে প্রতিষ্ঠানটি স্কুল ও কলেজে বিভাজিত হলে কলেজটিতেই থিতু হলেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি শহরের দীনি প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম(বর্তমানে জামিয়া ইসলামিয়া) মাদ্রাসায় মুসলিম শরীফসহ বিভিন্ন বিষয়ে দরশ(পাঠসংযোগ) দেন। ওয়ায়েজ ও সুবক্তা হিসেবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা আমন্ত্রণে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেন না। আল্লামা মুফতি মাহমুদ, পীর দুদু মিয়াসহ বহির্বিশ্বের বড়মাপের বুযূর্গ যেমন পায়ের ধুলো রেখেছেন তেমনি কলেজ জীবনের সহকর্মী রাহাত খান, যতীন সরকার, গোলাম সামদানী কোরায়শী, এককালে ছাত্র, পরে সহকর্মী রিয়াজুল ইসলাম প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ আব্বার সাহচর্যমুগ্ধ হতেন অনায়াসে। লম্বা পাতলা রিয়াজভাই ছিলেন ওদের অভিভাবক। খুব আদর করতেন।বাইরে থেকে এসেই ত্রস্ত হয়ে অযুর পানি চাইতেন। বাইরের বারান্দার দক্ষিণ মাথায় বসে নিবিষ্টমনে অযু করতেন। পরে বাম ঘরানায় চলে গেলেন।

তজবিহ হাতে নিয়েই বাইরের বারান্দায় পাতা চৌকিতে পা তুলে বসে তরিতরকারি বয়ে নিয়ে আসা লোকটাকে ইশারায় কাছে ডেকে জালি কুমড়ার পেছনের ফুল দেখে পরখ করে এটাওটা জিজ্ঞেস করছেন। ঠিক পেছনই গোল খাঁচায় করে দেশিমুরগি (হাইব্রিড জাত তখন সুদূর কল্পনা) বিক্রেতা অপেক্ষা করছে কখন আব্বার ফুসরত হবে তার দিকে তাকানোর। ফুলবাড়িয়া দেউখোলা থেকে ঘোড়ায় চেপে চাল নিয়ে আসে বিক্রেতারা। লাল কুড়া লেগে থাকা বিরই, নাইজারশাইল, কাইশ্যাবিনি… স্থানীয় নামে জানা বেশকিছু জাতের চাল নিয়ে আসে- যার দাম মণপ্রতি সতের থেকে ঊনিশ টাকা। আসে থরেথরে সাজানো বর্তুল মুখওয়ালা চারকোণাকৃতির টিনে গুড়দই মুড়ি…। ঘোড়ার পিঠে করে আজ এলো মুন্সি। খানিকটা উঁচুস্বরেই আব্বাকে হুজুর বলে ডাক দেয়। আব্বাও বেশ স্নেহশীল। দরদামের ফাঁকে খোঁজখবর নেন। কমবেশি সাহায্যও করেন।

আজিজ চাচা এসে পাশে বসলেন। অধ্যাপক আব্দুল আজিজ আনন্দমোহন কলেজে অর্থনীতি বিষয় পড়ান। আব্বার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহচর। এলেন বাসার পেছনে উত্তর দিকের বাসিন্দা অবনি বাবু আর সন্টু বাবু। খানিক বাদে এসে বসলেন ইংরেজি বিষয়ের সহকর্মী আব্বাস আলী সরদার, স্কুলের আরবি শিক্ষক ও স্থানীয় মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্যর আর ঠিক তার পেছনেই এলাকার পুরুত ঠাকুর শিবচন্দ্র ভট্টাচার্য, সবার পরিচিত শিবু ঠাকুর। চৌধুরী স্যর আর শিবুঠাকুর দুজনেই আব্বার খুব গুণমুগ্ধ। প্রায়ই খোঁজখবর নিতে সকাল বেলা চলে আসেন। চলে এলেন উল্টোদিকের বাসার মোশারফ হোসেন খান, এডভোকেট জুবেদ আলী, মোড়ের ডা. সফিরউদ্দিন আর নওয়াব আলী চাচা… ছোটখাটো একটা জমায়েত হয়ে গেল যেন দক্ষিণের খোলা বারান্দায়।

একটু কড়া মেজাজ হলেও চৌধুরী স্যর ওর প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। স্কুলে আরবি পড়ানোর পাশাপাশি টিফিন পিরিয়ডে একেকদিন একেক ক্লাসের ছাত্রদের নিয়ে যান স্কুলের পেছনের মসজিদ লাগোয়া পুকুরঘাটে অযুর প্রশিক্ষণ দিতে। সান বাঁধানো ঘাটে বসে তাকিয়ে থাকে সে পুকুরের টলটলে কালোজলের দিকে। বাতাসে কাঁপন লেগে তৈরি হয় ছোটছোট বৃত্ত। তারপর সবাইকে সারিবদ্ধভাবে মসজিদে নিয়ে ঢুকেন স্যর।

জোহরের নামাজ পড়ে টিফিন খেয়ে বিরতির পরের ক্লাসে গিয়ে বসে যে যার মত। চৌধুরী স্যর থাকলে অন্যথা হওয়ার জো নেই। বাসার পেছনেই দূর্গাপূজোয় বেশ বড় প্যাণ্ডেল হয়। উঁচুলম্বা গৌরবর্ণের চশমা পরা শিবুঠাকুর মন্তর (বেদের শ্লোক) আওড়ে একটা বড় কাঁসার থালায় ভেজা আতবচালের সাথে কলা চটকে নিয়ে ঘুরেঘুরে প্রসাদ বিলোয়। বড়সড় থালায় আরো থাকে বাতাসা, নাড়ু আর জবা ফুল…

আব্বার হাঁপানির টানটা বাড়াবাড়ি রকমে উঠে গেল। বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে কালো টিকিয়া জ্বালিয়ে ধুয়ো নিলেন। কাজ হলো না তেমন। পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন ডা. রবি সেন। পঁচাপুকুর পার রেললাইনের ধারে একই ধরনের আধাপাকা কয়েকটি বাড়ির প্রথমটিতে থাকতেন। হেঁটে কি দৌড়ে গিয়ে খবর পাঠাতো ওরা। বিশাল বপু নিয়ে রিক্সায় বসতেন। পাশে কারো বসার জায়গা হতো না। ওরা আবার রিক্সার পেছন পেছন দৌড়ে বাসায় চলে এসে তার পেটমোটা ব্যাগটা ধরতো।

আরও ক’জন পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন। একজন ছিলেন ডা. মোহাম্মদ আলী। বড় সজ্জন। আব্বার সাথে হৃদ্যতাও ছিলো বেশ। কেউ কেউ চেনার সুবিধের জন্য বলতো বাইশ আঙ্গুইলা ডাক্তার। সেআমলে এমন রেওয়াজ ছিল। বসতেন গাঙ্গিনার পাড় মোরে টিনের একচালা একটা ঘরে। মনে পড়ে, জ্বর হলে আব্বা নিয়ে যেতেন তার কাছে। নাড়ি পরীক্ষা করে, বুক পিঠ দেখে, জিভ বের করতে বলে চোখ টেবে দেখে ছোট কাগজে অবোধ্য আঁচড়ে কী যেন লিখে পেছনে মৃদু ঘাড় বাঁকিয়ে কাউকে ডাক দিতেন। জোড়া শাদা রঙের পর্দা সরিয়ে পেছন থেকে কম্পাউন্ডার এগিয়ে এলে কাগজটা তার হাতে ধরিয়ে দিতেন। একটু পরে কম্পাউন্ডার বাবু কাগজের দাগ কাটা চ্যাপটা শিশিতে কালচে খয়েরি রঙের মিক্সচার নিয়ে এসে হাতে ধরিয়ে বুঝিয়ে দিতেন। মিষ্টি তেঁতো এক অদ্ভুত আস্বাদন ছিল। তারপরও ওরা গেলতো। জ্বরটা যেন সাড়ে।

ধবধবে শাদা ধুতি আর ফতোয়া পরে রিক্সা থেকে নামলেন ডা. রবি সেন। মালকোঁচা দিয়ে ধুতি পরার কারণে হাঁটুর নিচে ফর্সা পা দুটো উঁকি দিচ্ছে। ঘরে ঢুকেই স্মিত হেসে বলে উঠলেন : স্যর, আবার অনিয়ম করছেন বুঝি…! দুহাতে সামনে ভর দিয়ে বিছানায় বসে জোড়ে জোড়ে দম নিচ্ছেন আব্বা। ডাক্তার কাকা কালো রঙের আয়তকার ব্যাগ থেকে স্টেথোস্কোপটা বের করে বুকে পিঠে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ধরে ধরে পরীক্ষা করে বলছেন : বাড়াবাড়িটা হইল কি কইরা? খাওয়া দাওয়ার কোন অনিয়ম হইছিল? কী খাইছিলেন…? বড়ভাই উত্তর দিকের ঘর থেকে পাঞ্জাবির হাতায় হাত ঢুকাতে ঢুকাতে এসে বললেন : বোয়ালমাছ খাইছিলেন…. আব্বার খুব পছন্দ …

ডাক্তার কাকা বিজ্ঞের মত হু ম ম… বলে দম ছেড়ে বললেন : বোয়ালমাছ, মিরকামাছ, চিংড়ি, গরু, মাসকলাই… একদম দিবেন না, স্যর চাইলেও না… ছোটটারেও দিবেন না…। বলে ব্যাগ থেকে সিরিঞ্জ আর শাদা পাউডারের ছোট গোল একটা শিশি (অ্যাম্পুল) বের করলেন। নূরু যথারীতি স্টিলের বাটিতে গরমপানি এগিয়ে দিল। গোল টুলের ওপর রাখা গরমপানির পাত্রে সিরিঞ্জ ডুবিয়ে জীবাণুমুক্ত করার প্রক্রিয়া সারার পর সামনে নুতুন করে আরেক বাটি পানি রাখা হল। এবার সিরিঞ্জ-এ গরম পানি নিয়ে ধুয়ে সেটা ফেলে দিয়ে স্বচ্ছ কাঁচের ছোট্ট ডিস্টিল ওয়াটারের শিশির সরু মাথাটা টিপ দিয়ে ভেঙে তা থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে কতোকটা তুলে নিয়ে শাদা পাউডার রাখা অ্যাম্পুলে ঢুকিয়ে ভাল করে ঝাঁকিয়ে নিয়ে মিশ্রণটা সিরিঞ্জে ভরে আব্বার ডান হাতের কুনুইয়ের উপর ভেজা তুলো ঘঁষে সেটা খাটের নিচে রাখা চিলিমচিতে ফেলে সুই ফোটালেন। আব্বা কতক্ষণ পরই শুয়ে পড়লেন।

আব্বা ঘুমুচ্ছেন। আর পায় কে! পূব দিকের উঠোনে নেমে গেল। একলাফে খরির ঘরের ভেতর শুকনো নারকেল ডাঁটা দিয়ে তৈরি ইট বিছানো খেলনাপাতির দোকানে। ঘরটার পশ্চিম দিকে বড় কাঠের ডুমের ওপর কুড়াল দিয়ে লাকড়ি চেড়াই হচ্ছে। কাছা মেড়ে আদুল গায়ে লোকটার নাম খালেক। কুড়ালের আছাড়ি মাথার ওপর তুলছে আর সজোরে হুু অ্ … করে একটা ধ্বনি নিচের দিকে ছুড়ছে। শব্দটা আর্তস্বরের মত ঐখানটায় ঘুরপাক খেতে খেতে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়!

খড়ির ঘর বোঝাই কাঁচা আমকাঠের চেলা, একদিকে খাড়া করে রাখা সারিসারি পাটশোলা…। আমকাঠের চেলার কাঁচা গন্ধ নাকে বেমক্কা এসে লাগে। মোটা বাঁকলে একটু পরপর খয়েরি রঙের কঁষ …। একবার এখান থেকে খানিকটা কঁষ তুলে নিয়ে খাতার কাগজ ছিঁড়ে খেলনা বানাতে লাগানোর চেষ্টা করে। পরে হাতের আঙুলে ঘাঁ হয়ে যায়। ইয়াসিন নানার কবরেজি অসুধে লম্বা সময় নিয়ে সেই ঘাঁ সাড়ে। ইয়াসিন নানা সোনারগাঁও থেকে মাসে একবার এসে কদিন থেকে নিয়ম করে চিরতার পানি, কালিজিরা ভর্তা আর নিমপাতা ভেঁজে খাওয়াতেন। জলবসন্ত হলে রাতদিন মশারি টানিয়ে মশারির কোণেকোণে নিমপাতা ঝুলিয়ে রাখতেন, নিমের ডাল দিয়ে ঝাড়ফুঁক করতেন, পথ্য তৈরি করে খাওয়াতেন। ক্রিমি হলে চুনের পানি খাওয়াতেন। কাল ছোট্ট বিচির মত ঔষধ, ক্রিমির ঔষধ- সেটা কলার মধ্যে ভরে খাওয়াতেন।

নারকেল গাছ সাফ করা হয়েছে। গাদাগাদা সবুজ ডাঁটা পড়ে আছে মাঠের এ দিকটায়। আহা! কী সবুজ! বেশ কদিন পড়ে থাকে এ নারকেল ডাঁটা। আস্তে আস্তে ছাড়ানো হয় পাতা শলা আর কেটেচিরে টুকরোটুকরো করে রাখা হয় মোটা ডগা, ডাঁটা। ওরা অবসরে শুয়েবসে গড়াগড়ি দিয়ে সুখ নেয় আর পাতা ছিড়ে শলা দিয়ে চশমা, হাতঘড়ি, পাতা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে লম্বা করে বাঁশি আর নানা খেলনা বানায়।

ফকফকে জোছনা। পিঠেপিঠি ভাইবোনগুলোর কেউ নারকেল ডাঁটার ওপর আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। কেউ খেলনা চশমা আর ঘড়ি বানানো মশক করছে, কেউবা এই আবছা আলোতেই শলা তুলছে। কালো পিঁপড়ে পিলপিল করে হাঁটছে, ডাঁটায়, ওদের গায়ে… আর ওরা? ধবল জোছনায় আকাশপটে কী যেন খুঁজে ফিরে …

এর নাম কি কল্পনার ভাসান, স্বপ্নের মোড়কে স্বপ্নের মিছিল, নাকি এলেবেলে জীবনের তিয়াস …

পূর্ববর্তি সংবাদহাল্কা বৃষ্টিতেই খোড়াখুড়ির রাস্তায় চরম দুর্ভোগ
পরবর্তি সংবাদহিন্দু-মুসলিম বন্ধুত্বের ঐতিহ্যেও রক্ষা পাচ্ছে না মিও মুসলিমরা