পল্টন টু মিরপুর : দুস্তর পারাবার

আতাউর রহমান খসরু  ।।  

৮ অক্টোবর সোমবার। সন্ধ্যে ৬টা। ঢাকার পল্টন মোড় থেকে যাত্রা শুরু। গন্তব্য মিরপুর। বাসের গেটে পা রাখতেই মনে ভর করলো শঙ্কা …। ভাবছেন, এতো আয়োজন করে কেন বলছি রাজধানীর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার কথা। ঠিক অ্যাডভেঞ্চারে যেমন বলা হয়। কারণ, মিরপুর যাওয়া এখন আর চাট্টিখানি কথা না। মতিঝিল থেকে মিরপুর যেতে এখন ধুলো-বালি, যানজট, উঁচু-নিচু রাস্তার ঝাঁকুনির সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় যাত্রীদের। যাই হোক, আসুন! যাত্রা শুরু করি।

 

সাধনার স্বাধীন

সন্ধ্যে ৬টায় পল্টন মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। উদ্দেশ্য মিরপুর১২-এর গাড়ি ধরা। শুরু হলো অপেক্ষা। শুধু অপেক্ষা নয় যেন অন্তহীন অপেক্ষা। গুলিস্তান ও মতিঝিল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গাড়ি আসছে। কিন্তু মিরপুর১২-এর গাড়ি দেখছি না একটিও। অন্যদিকে ভীড় বাড়ছে প্রতি মিনিটে। আর প্রতিটি মানুষকেই মনে হচ্ছে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। যেন তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমি কাঙ্ক্ষিত গাড়িতে উঠতেই পারবো না। এক, দুই, তিন … দশ মিনিট পার হলো। কিন্তু গাড়ির কোনো চিহ্ন দেখছি না। এভাবে পার হলো আরও ৫ মিনিট। দূর থেকে চোখে পড়লো স্বাধীন পরিবহন। মাওয়া টু মিরপুর-১২। শুরু হলো যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জিতে গেলাম। জনজটের ধাক্কায় উঠে গেলাম গাড়িতে। সিট না পেলেও কোনো মতে দাঁড়ানোর জায়গাটা পেলাম। বাহ! জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছেন কয়েকজন নারী। তারা যুদ্ধে জিততে পারেন নি। অথবা অংশগ্রহণের সাহসই পান নি।

 

আশার গুড়ে বালি

পল্টন মোড় থেকে স্বাধীন পরিবহন খানিকটা স্বাধীনভাবেই এগুচ্ছিলো। কিন্তু তা খুব বেশি স্থায়ী হলো না। ইন্জিনিয়ারিং ইনিস্টিটিউট পার হতেই যানজটে আটকে গেলো সে। আবার সময় গণনা শুরু। এক, দুই, তিন …। ২০ মিনিটে শাহবাগ মোড়ে পৌঁছালাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য! শুনলাম মোড় অবরোধ করা হয়েছে। শাহবাগ দিয়ে আর কোনো গাড়ি যেতে দেয়া হবে না। ঘুরাও গাড়ি। হোটেল শেরাটনের পাশ দিয়ে বের হতে হবে। সেখানে যেন গাড়ির মিছিল। হোটেল শেরাটনের ট্রাফিক সিগন্যাল পার হতে কেটে গেলো আরও ১৫ মিনিট।

শেরাটনের সিগন্যালের সাথে সাথে ভাগ্যও খুললো কিছুটা। শাহবাগ মোড় অবরোধের সুফল পেলাম কিছুটা। ১৫ মিনিটে কারওয়ান বাজার-ফার্মগেট হয়ে পৌঁছালাম বিজয় সরণী। রাস্তার পাশে প্রতিটি বাস স্টোপেজে শত শত মানুষের অপেক্ষা।

 

ঢাকা শহরে নতুন?

বিজয় সরণী প্রবেশের মুখেই থেমে গেলো গাড়ি। কারণ কি? কিসের জ্যাম? প্রশ্ন করতেই পাল্টা প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম। ঢাকা শহরে নতুন? এখানে জ্যাম নিত্যকার। প্রশ্নকারীর নাম মাহিদুল ইসলাম সাগর। বেসরকারি ব্যাংক ইউসিবিতে চাকরি করেন। অফিস কারওয়ান বাজার। বাসা মিরপুর অরজিনাল ১০। মিরপুর যাতায়াতের অভিজ্ঞতা বলছিলেন তিনি। প্রতিদিন মিরপুর-১০ নম্বর মোড় থেকে সকাল ৮টায় গাড়িতে ওঠেন তিনি। তবুও শঙ্কায় থাকেন ১০টার ভেতর অফিসে ঢুকতে পারবেন কি না। ফিরতে সময় লাগে আরও বেশি।

কথার ফাঁকে কখন বিজয় সরণী, চন্দ্রিমা উদ্যান পেরিয়ে বাণিজ্যমেলার মোড়। রাস্তার মাঝে টিনের বেড়া। মাহিদুল ইসলাম খানিকটা খেদ নিয়েই বললেন, দুর্দশার মূল কারণ এটিই। জিজ্ঞেস করলাম, মেট্রোরেল প্রকল্প? বললেন, হ্যা। বছরের পর বছর রাস্তা ব্লক করে এভাবে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে কাজ হয় বলে আমার জানা নেই। কর্তৃপক্ষের উচিৎ ছিলো জনগণের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে দ্রুত গতিতে কাজ শেষ করা। বললাম, এটা তো সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ১০ মেগা প্রকল্পের ১টি। শুনে খানিক শ্লেষের হাসি হাসলেন। মৃদু স্বরে বললেন, এবার বোঝেন ঠেলা।

ঘুম থেকে উঠে দেখি রাত ৮.২০ মিনিট

স্বাধীন যখন অনেক বাধা পেরিয়ে আগারগাও তালতলা পৌঁছালো, তখন সৌভাগ্যক্রমে একটি সিট পেয়ে গেলাম। ব্যাংকার মাহিদুলও এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। সারা দিনের ক্লান্তিতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যেই টের পেলাম দুলতে দুলতে এগুচ্ছে স্বাধীন। আর আমরা যেন নৌপথের যাত্রী। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দেখলাম মাহিদুল ইসলাম নামছেন। অরজিনাল ১০! বাঁচা গেলো। তাহলে পৌঁছে গেছি! ঘড়ির কাটায় চোখ পড়তে ভড়কে গেলাম। রাত এখন ৮টা বেজে ২০ মিনিট।

 

জানালাটা লাগিয়ে দেন প্লিজ!

প্রচণ্ড ঝাঁকুনির পর স্বাধীন যখন আপন সত্ত্বায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে পাশের সিট থেকে এক মায়ের অনুরোধ জানালাটা লাগিয়ে দেন প্লিজ! রাস্তার প্রচণ্ড ধুলো-বালিতে গাড়ির ভেতর অন্ধকার অবস্থা। নবজাতককে ধুলোর হাত থেকে রক্ষা করতে ব্যস্ত মা। জানালা শক্ত হয়ে যাওয়ায় আটকাতে পারছেন না তিনি। চেষ্টা করে আমরাও ব্যর্থ। অবশেষ গাড়ির হেল্পারের হেল্প নিতে হলো আমাদের। চোখে মুখে প্রচণ্ড বিরক্তি তার। এই রোডে গাড়ি চালায়া মরণ! গাড়ির পার্সপাতি, জানালা-দরজা কিছু ঠিক রাখা যায় না। এরপর মেট্রোরেলের গোষ্ঠি উদ্ধার করে দুটো গালি। ততোক্ষণে পৌঁছে গেছি মিরপুর-১২। নেমে পড়লাম। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু অবচেতনে আমার মনের ভেতর ধ্বনিত হতে লাগলো হেল্পারের শেষ দুটি বাক্য।

পল্টন থেকে মতিঝিল আসার এ বর্ণনা নিত্যকার ঘটনা। এ রোডে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ যাতায়াত করেন। তাদের কথা ভাবতেই মনটা তেঁতো হয়ে গেলো। এ মানুষগুলো কিভাবে পারে! জনগণের এ চরম দুর্ভোগ দেখার কি কেউ নেই। এ দুর্ভোগ শুধু কি মিরপুরবাসীর? এ যেন ঢাকাবাসীর ভাগ্যলিখন। প্রতিদিন এ শহরে শুধু যানজটে নষ্ট হয় ৮৩ লাখ কর্মঘণ্টা। বছরে ক্ষতি ১ লাখ কোটি টাকা। তারপরও কেন এ সংকট নিরসনের উদ্যোগ নেই কর্তা ব্যক্তিদের মধ্যে।

পূর্ববর্তি সংবাদএকটা গল্প এবং আরও কিছু খুচরা গল্প ।। হাসান ইনাম
পরবর্তি সংবাদসৌদি নৌযানে হুথিদের হামলা