‘বাচ্চাদের মেহনতের মাধ্যমেই কেন জান্নাতে যেতে হবে? নিজে কিছু করুন’ -মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক

তালীমুদ্দীন একাডেমি কুমিল্লা। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সব শ্রেণির সব পেশার মানুষের জন্য দ্বীন শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া ঢাকা-এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত।  জুলাই ১৮-এর কোনো মুবারক মজমায় বয়স্ক ছাত্রদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন বরেণ্য আলেমে দ্বীন, প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ হজরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক। বক্তব্যে পরিণত বয়সেও কুরআন শরীফ হেফজ করার প্রেরণা ও পদ্ধতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করেন। সে বক্তব্যের নির্যাস এখানে পেশ করা হলো।

 

আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মেহেরবানি, তিনি আমাদেরকে একটি দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে, দ্বীনি মাহফিলে দ্বীনি ফিকির নিয়ে বসার তাওফিক দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ!

আল্লাহুম্মা মা আমসা বি মিন-নি’মাতিন ওয়া বিআহাদি মিন খালকিক। ফা মিনকা ওয়াহদাকা। লা শারিকা লাকা, ফা-লাকাল হামদু ওয়া-লাকাশ শুকরু।

হে আামার আল্লাহ! এই সন্ধ্যায় আমার মধ্যে, আপনার যেকোনো মাখলুকের মধ্যে ছোট-বড় যত ধরনের যত নেয়ামত আছে সব ধরনের নেয়ামত একমাত্র আপনার পক্ষ থেকে। আপনার কোনো শরিক নেই। সকল হামদ আপনার জন্য, সকল কৃতজ্ঞতা আপনার জন্য।

এই দোয়া সকালে পড়লে ‘আমসা’ জায়গায় ‘আসবাহা’ পড়তে হবে। এটি সকাল-বিকেলের শুকরিয়া আদায় করার দোয়া। আবু দাউদ শরিফে ইরশাদ হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, সকালে এই দোয়া পড়ো, সকালের কৃতজ্ঞতা আদায় হয়ে যাবে। বিকালে পড়ো, বিকালের শুকরিয়া আদায় হয়ে যাবে। শুকরিয়া আদায় খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে বিভিন্ন জায়গা থেকে দ্বীনি ফিকির নিয়ে একত্র হয়েছি এটা অনেক বড় নেয়ামত এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায়ের মতো বিষয়।

আজকের মাহফিলের বিষয়বস্তুটাই আল্লাহর নেয়ামতস্বরূপ। এটি একটি ঈমানি আমল। এতদিন তালীমুদ্দীন এবং এমন যেসব প্রতিষ্ঠানে সাধারণ মানুষকে–যারা দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করতে পারেননি এবং বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়েছে–তাদের দ্বীন শেখানো হতো। কিন্তু আজ এমন একদল মানুষ হাফেজ হওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছেন যাদের হাফেজ হওয়ার চিন্তাও আমরা করতে পারিনি।

আমাদের দেশের সাধারণ মাদরাসাগুলোতে ছোটদের হাফেজ বানানো হয়। সেখানে বড়দের পড়ার সুযোগ নেই। মেধার বিচারে শিশুদের হিফজ করতে ১ বছর থেকে ৫-৬ বছর লাগে। অনেক সময় শিশুরা পারে না্।চাপ দিলে তাদের ওপর অবিচার হয়ে যায়। তবুও বাবা-মা জোর করে হিফজখানায় রেখে দেয়। উদ্দেশ্য, বাচ্চার উসিলায় জান্নাতে যাবে। শিশুদের উপর জোর প্রয়োগ করবেন না। এটা তার দোষ না। আল্লাহ সবাইকে ত্রিশ পারা মুখস্থ করার মতো মেধা দেননি। আল্লাহ ত্রিশ পারা হিফজ করার আদেশও দেননি। অনেক সময় শিশুর বয়স ১৫-১৬ বছর হয়ে যায়, তবুও তার নিস্তার নেই। এটা অন্যায়, খুব অন্যায়। শিক্ষকদের সাথে পরামর্শ করুন। সে যেটা পারবে সেখানে যাওয়ার সুযোগ দিন।

কুআন পাঠ

সবচেয়ে বড় কথা, বাচ্চাদের মেহনতের মাধ্যমেই কেন জান্নাতে যেতে হবে? নিজে কিছু করুন। আপনার জান্নাতে যাওয়ার জন্য আরও অনেক রাস্তা রয়েছে। আমার আম্মা একজন হাফেজা! কীভাবে? তেলাওয়াত করতে করতে তিনি হাফেজা হয়ে গেছেন। তিনি অবিরাম তেলাওয়াত করে যান। বাচ্চাদের পড়াতে থাকেন। উনার ঘরই একটি মাদরাসা। আমি যখন মায়ের কাছে কায়েদা আমপারা পড়তাম আমাদের ঘর ও ঘরের বাইরের উঠোন কোথাও খালি জায়গা থাকতো না। ছোট ছোট শিশুরা মায়ের কাছে পড়তে আসতো।

আমাকে আমার বাবা-মা হিফজখানায় ভর্তি করাননি। তাই আমি হাফেজ না। একজন আলেম হয়েও না। অথচ আমার মা একজন হাফেজা। আল্লাহর রহমতে তিনি নিজ চেষ্টায় হাফেজা হয়েছেন। এখন আমার হাফেজ না হওয়া কার দোষ? নিশ্চয় আমার দোষ। আমাদের দেশের মুসলমানের সাধারণ মানসিকতা হলো হিফজখানায় পড়লে হাফেজ হবে, না পড়লে হবে না। মাদরাসায় পড়লে দ্বীন শিখবে, না পড়লে শিখবে না। মনে করবে এটা মৌলভিদের কাজ। আর শিখলেও বাংলা থেকে শিখবে। কুরআনের বাংলা উচ্চারণ, হাদীসের বাংলা উচ্চারণ। বাংলাবাজার থেকে বই কিনে আনবে। অথবা ইংরেজি উচ্চারণে শিখবে। যে যে ভাষায় দক্ষ সে ভাষায় দ্বীন শিখবে। দ্বীনকে দ্বীনের ভাষায় শিখবে না।

অজুহাত হলো, আমাকে মাদরাসায় পড়ানো হয়নি। মনে করা হয়, দ্বীনের ভাষায় দ্বীন শিখবে আলেমরা। যারা মাদরাসায় পড়েছে। বিষয়টা তা নয়। আপনি স্কুল-কলেজ যেখানেই পড়েন না কেন, দ্বীন শিখতে হবে দ্বীনের ভাষায়, কুরআন শিখতে হবে কুরআনের ভাষায়। কুরআনের বিধানগুলো শিখতে হবে নিজের ভাষায়। এটা অসম্ভব কিছু নয়। বিশেষত আমরা যারা তালীমুদ্দীনের ছাত্র হয়েছি আমরা তো বুঝতে পেরেছি বিষয়টি সম্ভব।

হিফজের বিষয়টিও এমন। আজ থেকে ১৭-১৮ বছর আগে আমি চট্টগ্রামের পটিয়া মাদরাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে মিশরের কয়েকজন আলেম ছিলেন। তারা আমাকে বললেন, তোমাদের দেশের এ কী নিয়ম! যারা হিফজখানায় পড়ে তারাই কেবল হাফেজ হয়! যারা ছোটবেলায় হিফজ করেছে তারা তো করলোই আর যারা তোমরা কিতাবখানায় পড়ছো তারা অন্য বিষয়গুলোর পাশাপাশি হিফজের একটি ক্লাস কেন কর না? যে কয় পারা হয় হলো, যে কয় সুরা হয় হলো। ক্ষতি কী? এটাও হিফজ।

আমাদের মানসিকতা হলো, আমি যদি ত্রিশ পারার হাফেজ হতে পারি তাহলে হবো, না হলে হবো না। আমার ইয়াদ যদি খুব ভালো হয় তাহলে হিফজ করবো, না হলে করবো না। এত শর্ত কেন করি? দশ পারার হাফেজ হলে কোনো সমস্যা আছে?

যারা স্কুলে গেছেন তারা ভাবেন, আমরা হাফেজ হবো কিভাবে? এ চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দিন। তাদের জন্য হিফজ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা উদ্যোগের কথা ঘোষণা করার আগেই অনেকে ফোন করে বলেছেন, আমাদের যেভাবে দ্বীন শেখার ব্যবস্থা করেছেন, সেভাবে হিফজ করারও ব্যবস্থা করে দিন। আমরা যারা যে পেশা ও জায়গা থেকে দ্বীন শেখার জন্য তালীমুদ্দীনে এসে ভর্তি হয়েছি, আমরা হিফজখানায়ও ভর্তি হবো।

আমি বলছি, ভয় পাবেন না। চেষ্টা করুন। হিফজের চেষ্টা করা আমার দায়িত্ব, অন্তরে হিফজ বসিয়ে দেয়া আল্লাহর শান। যে যখন সময় পান তখন পড়বেন। শিক্ষক আপনাকে বলে দেবেন কিভাবে পড়বেন। প্রথমে দেখে দেখে পড়বেন। এরপর দেখে-না দেখে, মানে না দেখার মতো দেখে পড়বেন। শেষে একদম না দেখে পড়বেন। দশ বার, পনের বার পড়বেন।

আপনার সাধ্যমতো চেষ্টা করেন। কী পরিমাণ আত্মস্থ হলো তা আল্লাহর কাছে ছেড়ে দেন। অনেকে ভয় পায় হিফজ করে ভুলে গেলে কবিরা গুনাহ। এর অর্থ কি হিফজ না করা? এর অর্থ হিফজ করো এবং ধরে রাখো। নিজের প্রতি আস্থা না থাকলেও হিফজ করুন। অনেকে হজ ছুটে যাওয়ার ভয়ে হজ করে না। তারা গুনাহগার হয়। হজ ধরে রাখার অর্থ কী? অর্থ হলো, ঈমান-আমল ও তাকওয়া-পরহেজগারির উপর থাকা। এটা হজ না করলেও ফরজ। এগুলো হজ ফরজ না হলেও ফরজ। বরং লোকটা হজ না করে গুনাহগার হচ্ছে। আপনি হিফজ করুন, তেলাওয়াত অব্যাহত রাখুন, কুরআনের সাথে সম্পর্ক অব্যাহত রাখুন। এরপর হিফজ মজবুত না থাকলেও আপনি গুনাহগার হবেন না। গুনাহগার হবে সে যে হিফজ করেছে অথচ তেলাওয়াত করে না। ইচ্ছে করে অবহেলা করলে গুনাহগার হবে। হাফেজ হওয়াকে ভয় পাবেন না।

আপনি হিফজ করুন, তেলাওয়াত অব্যাহত রাখুন, কুরআনের সাথে সম্পর্ক অব্যাহত রাখুন। এরপর হিফজ মজবুত না থাকলেও আপনি গুনাহগার হবেন না।”

হিন্দুস্তানের একজন বয়স্ক ডাক্তার। হজরত থানভি রহ.-এর মুরিদ হয়েছেন। তিনি হিফজ শুরু করলেন। বৃদ্ধ বয়সে স্মৃতি দুর্বল হয়ে যায়। মানুষ তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি শেষ করতে পারবেন? তিনি উত্তর দিলেন, হিফজ শেষ করা উদ্দেশ্য না। হিফজ করতে করতে কবরে যাবো।

কেউ যদি ত্রিশ পারা হিফজ করার আগে মারা যায় তাহলে সে সফল কী না? আপনার কী ধারণা আল্লাহ তায়ালা তাকে হাফেজ হিসেবে হাশর করবেন না? শুরু করা এবং মেহনত করা আমার কাজ। আল্লাহ আমাকে কত দূর নেবেন সেটা তিনি জানেন।

সব বয়সের মানুষই হিফজখানায় ভর্তি হবেন। বিশেষত যারা স্কুল-কলেজে পড়ছেন–যারা পড়া বোঝেন, মনে রাখতে পারেন-তারা ভর্তি হবেন। তাদের শুধু মুহাব্বতের প্রয়োজন। আল্লাহ কুরআনকে সহজ করেছেন। ঈমান পাকা করুন, কুরআনের সাথে সম্পর্ক মজবুত করুন, দেখবেন কুরআন কত সহজ। বড় হয়ে হিফজ করা একটু কঠিন। কঠিন লাগে তারপরও যদি আমরা মেহনত করি আল্লাহ দ্বিগুণ সওয়াব দেবেন। এরপরও আল্লাহর উপর নারাজ হওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি? দুর্বলতা ও অক্ষমতা তো আমার।

আরব দেশে আমাদের দেশের মতো হিফজখানা নেই। সেখানে শিশুরা আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত ২-৩ ঘণ্টা (আরবরা আসরের নামাজ একটু আগে পড়েন) পড়ে হিফজ সম্পন্ন করেন। আপনারা এক ঘণ্টা পড়বেন। সমস্যা নেই। সময় দিতে থাকেন। আপনি এটা হিসাব করবেন না কবে ত্রিশপারা শেষ হবে। আপনার কাজ হলো চলতে থাকুক। কবি বলেন,

কদম হ্যায় রাহে উলফত মে, তো মানজিল কি হাওয়াস ক্যায়সি

জাহাঁ তো আইনে মানযিল হ্যায়, থাকান সে চুড় হো জানা।

আমি তো আল্লাহর রাস্তায় আছি, আমি কুরআন হিফজ করতে করতে আল্লাহর কাছে যেতে চাই। আমি চলতে থাকবো। যদি চলতে চলতে আমার মৃত্যু হয়ে যায়, আমার হিফজ শেষ না হয় তবুও আমি সফল। এ পথে চলতে চলতে মৃত্যু হলে শাহাদাতের মৃত্যু হবে।

হাদিস শরিফে এসেছে, ‘মান খারাজা ফি তালাবিল ইলমি ফাহুয়া ফি সাবিলিল্লাহি হাত্তা ইয়ারজিআ।’

অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করার জন্য বের হলো যতক্ষণ পর্যন্ত না ফিরবে ততক্ষণ সে আল্লাহর রাস্তায়। আমরা তো বের হয়েছি সবচেয়ে বড় ইলম কুরআনের জন্য। কুরআনের নাজেরা শেখা, হিফজ করা, বিধান শেখা-সবগুলোই দ্বীনের ইলম। সুতরাং আমরা আল্লাহর রাস্তায় রয়েছি। নিয়তকে বড় করবেন। সবাই চেষ্টা করবেন। আল্লাহ তাআলা সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমিন!

পূর্ববর্তি সংবাদচোরাই মোবাইল কেনা কি জায়েজ?
পরবর্তি সংবাদপিরামিড আর স্ফিংক্সের রহস্যরাজ্যে