কেন নিজস্ব মিডিয়া হাউস

 

সরদার ফরিদ আহমদ ।।

সংবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়, স্থিতাবস্থাকে ক্ষুন্ন করে, বিঘ্নিত করে বা পরিবর্তিত করে কিংবা পরিবর্তনের নিশ্চিত সম্ভাবনা তৈরি করে-এমন ঘটনার বিবরণীই হচ্ছে সংবাদ। এখন কথা হলো, এই বিষয়গুলো যারা প্রচার করে তাদের ভূমিকা কী? তারা কি প্রভাবকের ভূমিকা রাখতে পারে? তারা কি পরিবর্তনের গতিধারা পাল্টে দিতে পারে? পরিবর্তনের ইতিবাচকতা থেকে নেতিবাচকতা কিংবা নেতিবাচকতা থেকে ইতিবাচকতার দিকে ঘুরিয়ে পারে? আরো স্পষ্ট করে বলি। মিডিয়া কি ঘটনার বিবরণকে তার মতো পরিবেশন করে নিজের পলিসি মতো মত-পথের সৃষ্টি করতে পারে? এ সব প্রশ্নের জবাবে নানা তর্ক-বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু সবশেষে জবাব কিন্তু একটাই-পারে।

এ কারণে মিডিয়ার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনার সময় আমরা একটি বিষয় সবাইকে অবহিত করি। আমরা বলি, চারটি বিষয় বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিষয় চারটি হলো: রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং ধর্ম। আধুনিক বিশ্বে এই চারটি বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করে মিডিয়া। আর এখন মিডিয়ার পরিধি অনেক ব্যাপক এবং চরিত্রও ভিন্ন ভিন্ন। প্রভাব বলয়ের ক্ষেত্রও এখন বিশাল এবং কার্যকরী।

একটি মিডিয়া হাউস বিভিন্ন চ্যানেল থেকে সংবাদ পায়। তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি থাকে। আছে নিউজ এজেন্সি। আছে প্রেস রিলিজ। অন্য মিডিয়া হাউসও সংবাদ চ্যানেল হতে পারে। একটা সময় সংবাদ চ্যানেল এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন আর সেটি নেই। ইন্টারনেট আসায় সব কিছু পাল্টে গেছে। কেউ কেউ বলেন, ‘এলোমেলো হয়ে গেছে’। সংবাদ চ্যানেল এখন এতো বেশি যে, মিডিয়াকর্মীরা ‘এলোমেলো’ শব্দটি ব্যবহার করে এর ব্যাপকতা ও বিশালতাকে বুঝাতে চান।

ইসলাম টাইমস
সংবাদপত্র যখন বাকস্বাধীনতায় রুদ্ধ

সোশ্যাল মিডিয়ার সর্বগ্রাসী প্রভাবের আঁচ আমরা এখন প্রতিনিয়ত টের পাই। আপনি দেখছেন একে থামাতে দেশে দেশে শাসক গোষ্ঠী নানা আইন প্রণয়ণ করতে বাধ্য হচ্ছে। ক্ষমতা ধরে রাখতে তারা এটি করছে। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব এখন সুদূরপ্রসারী বলে ইতোমধ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে। মূলধারার মিডিয়াও অনেক সময় আগে খবর দেয়ার ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পিছিয়ে পড়ে। একটি সংবাদপত্র যেভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে পারে টিভি বা রেডিও সেটি পারে না। আবার টিভি যেভাবে পারে সেটি সংবাদপত্র বা রেডিও পারে না। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া তিনটির কাজ একাই করতে পারে। হয়তো বিষয়টিতে পেশাদারিত্বের ঘাটতি থাকে- কিন্তু কার্যকারিতায় কোনো ঘাটতি নেই। আর এ কারণেই ‘ভাইরাল’ শব্দটি এখন বাংলা ভাষারই একটি শব্দ হয়ে গেছে।

এ কারণে অনলাইন মিডিয়া এখন প্রচলিত সব মিডিয়াকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সংবাদপত্র, টিভি, রেডিও যা পারে অনলাইন মিডিয়া তা একাই পারে। আগেই বলেছি সোশ্যাল মিডিয়াও এ কাজটি পারে। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতার দিক থেকে অনলাইন মিডিয়া সোশ্যাল মিডিয়া থেকে অনেক এগিয়ে। আবার এটি সোশ্যাল মিডিয়াকেও ব্যবহার করে। এর মাধ্যমে নিজের ব্যাপ্তি এবং প্রভাব বাড়ায়।

মিডিয়ার নানা ধরণ ও কার্যকারিতা নিয়ে এতো কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, আমাদের মানতেই হবে মিডিয়া এখন সর্বগ্রাসী এবং এটিকে আমরা বাদ দিতে পারি না। এড়াতে পারি না। আমাদের মতামত তৈরিতে মিডিয়ার প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মিডিয়া এখন প্রতি মুহূর্তের অনুষঙ্গ, ধরন যাই হোক না কেন।

মিডিয়া নামক মারণাস্ত্র (ইতিবাচক বা নেতিবাচক যেভাবেই নেয়া হোক না কেন) যার হাতে থাকবে সে আমার আপনার চেয়ে বেশি শক্তিশালী-এটি মানতেই হবে। আর শক্তি যার বেশি সে আপনাকে প্রভাবিত করবে, পরিচালিত করবে – এটিও প্রকৃতির নিয়ম। আর আপনি যদি বেশি দুর্বল হন তাহলে আপনাকে দাস বানিয়ে ফেলবে। তখন নিজস্বতা বলে আর কিছু থাকবে না।

কিন্তু বোধসম্পন্ন একজন মানুষ কখনো তার নিজস্বতা বিসর্জন দেয় না। দিতে পারে না। দেয়া উচিতও নয়। আর এ কারণে যে অস্ত্র আপনাকে দাস বানাতে প্রতিনিয়ত কাজ করছে তাকে প্রতিহত করতে, ঠেকাতে আপনাকেও সে অস্ত্রের অধিকারী হতে হবে।

এই দক্ষতা ও জ্ঞানের অস্ত্রের বিষয়টির ব্যাপারে মুসলমানরা অনেক পিছিয়ে। উদাসীন। নির্লিপ্ত। কিন্তু দেখুন ইহুদিরা কিন্ত এ অস্ত্রের শক্তিমত্তা জানে এবং বুঝে বলেই বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলোর মালিক তারা। আর সব চেয়ে প্রভাবশালী সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকের মালিক জুকারবার্গ একজন ইহুদি। এ কারণে আমরা দেখি রোহিঙ্গাবিদ্বেষী স্ট্যাসাস ফেসবুকে ঠিকই থেকে যায়। জাতিবিদ্বেষী এসব স্ট্যাসাস ফেসবুক ডিলিট করে না। আর ফিলিস্থিনিদের বিরুদ্ধে ফেসবুকের অবস্থানের কথা সবার জানা।

তাহলে মুসলমানরা কী করবে? তারা কি মিডিয়া হাউস তৈরি করবে না? করবে। আছেও। কিন্তু মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত মিডিয়ার পরিচালকরা প্রায় সবাই কথিত প্রগতিবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ বলে নিজেকে পরিচয় দিতে আত্ম শ্লাঘা বোধ করে। যদিও তাদের এই আত্মশ্লাঘা আত্মঘাতি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তবুও তারা নিজের জাতির বিরোধিতাকেই কথিত প্রগতি ধরে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এদের কোনো জাত্যাভিমান নেই। আর নিজের ধর্ম সম্পর্কেও আসলে কিছুই জানে না। যদি জানে, ভুল জানে।

ইসলাম টাইমস
অনেক সংবাদপত্রের নেপথ্য এজেন্ডা থাকে ইসলামকে আঘাত করার

এর প্রতিকারের পথও আছে। আলেমরা এক্ষেত্রে এগিয়ে আসলে ইতিবাচক ফল আসবে বলে আমার বিশ্বাস। আলেমদের একটি সুবিধা হলো, তারা ধর্মের বিষয়টি জানেন। আবার সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা যা জানেন সেটিও আয়ত্বে আনতে পারেন। কম্পিউটারে দক্ষ অনেক তরুণ আলেমকে আমি দেখেছি। মিডিয়া বোঝেন এমন আলেমও আছেন। কিন্তু এদের ক্ষেত্র নেই। আমাদের দেশের মিডিয়ার কর্তারা আলেমদের সংবাদকর্মী হিসেবে গ্রহণ করেন না। সচেতনভাবেই করেন না। তারা চান না আলেমরা মিডিয়ায় আসুক, বিষয়টি জানুক। আমি কথাগুলো সরাসরি বললাম বলে কেউ কেউ ভ্রু কুঁচকাতে পারেন। কিন্তু সত্য সরাসরি বলাই বিধেয়।

এখন মিডিয়া হাউস গড়ার কাজে এগিয়ে আসতে হবে আলেমদেরই। এতে জাতি উপকৃত হবে। বিভ্রান্তি থেকে বাঁচবে। কারণ একজন প্রকৃত আলেম ধার্মিক হবেন-এটাই স্বাভাবিক। আর একজন ধার্মিক মানুষ উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ সমর্থন করতে পারেন না। অন্য ধর্মের মানুষের বিরোধিতায় সাম্প্রদায়িক আচরণ করাও তার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ ইসলাম সাম্প্রদায়িকতাকে সমর্থন করে না। একজন ধার্মিক মানুষ মানবিক হবেন- এটাই স্বাভাবিক নিয়ম।

কাজেই আলেমরা মিডিয়ায় এলে এর চরিত্র এবং চেহারা দুই-ই পাল্টে যেতে বাধ্য। পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা নিয়ে আলেমদের মিডিয়া হাউস গড়ার কাজে এগিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য প্রবীণ আলেমরা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেন। তাদের পক্ষে এটি সম্ভব। তাদের হাতে যদি এতো বিশাল বিশাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠতে পারে-মিডিয়া কেন নয়?

 

সরদার ফরিদ আহমদ

সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন

পূর্ববর্তি সংবাদজঙ্গলবাড়ির খোঁজে
পরবর্তি সংবাদহজের বাইরে হজক্যাম্প